বিশ্বনাথ পুরকাইতের কবিতা নিয়ে দু-চার কথা

 





বিশ্বনাথ পুরকাইতের কবিতা নিয়ে দু-চার কথা


প্রশান্ত হালদার


বাংলা কবিতা কেমন আছে, এরকম একটা প্রশ্ন তুলে বর্তমান বাংলা ভাষার কবিতা-লেখকদের দিকে তাকানো যায় কিনা, কিম্বা মুকন্দরাম, ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন, জীবনানন্দ, সমর, সুভাষ, উৎপল, বিনয়, আল মাহমুদ, স্বদেশ, ভাস্কর, দেবারতি, জয়, মৃদুল, রণজিৎ, প্রসূন, রাহুল, সংযুক্তাদের কবিতা-পুষ্ট বাংলা ভাষায় যারা নব-সংযোজিত স্বর তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করা যায় কিনা সেই ভাবনারই অংশ হিসেবে রচনাকালের শুরুয়াতকে মানদণ্ড ধরে গত শতাব্দীর ৯০ দশকের কবি বিশ্বনাথ পুরকাইতের কবিতা নিয়ে রইল দু-চার কথা।

 

বিশ্বনাথ পুরকাইত (জন্ম ১৯৬৪) বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য এযাবত প্রকাশ করেছেন ৬টি কবিতা গ্রন্থ। সংখ্যায় ৬টি হলেও, কলেবরে, সাকুল্যে সাড়ে-দশ ফর্মা মাত্র।

বিশ্বনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিম্নচাপের দিনগুলি (১৯৯৮) ৪৮ পৃষ্ঠার, দ্বিতীয় শান্তি শৃঙ্খলা (২০০৩) ৪৮ পৃষ্ঠার, খণ্ডচৈতন্য (২০০৬) ১৬ পৃষ্ঠার, ২০১৩ তে খণ্ডচৈতন্য-র পরিমার্জিত সংস্করণ সহ মিশ্রপ্রতিক্রিয়া মোট ৩২ পৃষ্ঠার, ২০১৮তে ২২ পৃষ্ঠার ভাষাবাহিত রোগশোক এবং ২০২২-এ ১৬ পৃষ্ঠার ঘটনাচক্রে


প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিম্নচাপের দিনগুলি’তে রণজিৎ দাশের কবিতা-প্রকরণের কিছু ছাপ থাকলেও বইটির একাধিক কবিতার কাছে পাঠকের ফিরে যেতেই হবে। মাত্রাবৃত্তে দু-একটা কবিতা ছাড়া বাকি সবই মাপা অক্ষরবৃত্তে লেখা। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কবিতাগুলিতে পরিমিত কথন, বর্ণনা-প্রবণতাকে পরিহার, আলংকারিক গয়নাগাটিহীনতার নির্ভার উপস্থাপনা লক্ষ্যণীয়। বাংলা কবিতার ধারাতে এই বই কোনো আইকনোক্লাস্টিক ভূমিকা না রাখলেও, তারুণ্যজনিত কোনো দুর্বলতাই প্রায় দেখা যায় না। পূর্ণবাক্য রচনা এই বইটির, তৎসহ বিশ্বনাথের প্রায় সমগ্র কবিতাজীবনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ ব্যাপারে তিনি বিনয়ের যোগ্য উত্তরসূরি। বিনয়ের মতোই তাঁর কবিতাও মূলত অক্ষরবৃত্তে, বাকিটা গদ্যে লেখা। ছন্দ নিয়ে বিশ্বনাথের কবিতায় তেমন কোনো পরীক্ষা বা নিরীক্ষণের জায়গা নেই।

বইটি থেকে একটি কবিতা—

 

প্রকৃতিপাঠ

খরা ও বন্যা ছাড়া অন্য কোনও ঋতু নেই যার

বিনয়ী শিশির তাকে কী দিয়ে ভোলাবে

 

জলের প্রতিটি কণা এমনকি চিবুকের ঘাম

যার কাছে পূর্বাভাস আগামী বন্যার

ত্বকের লবনে নোনা খরাস্মৃতি জাগে

 

জড়িয়ে তার পায়ে পায়ে কতদূর যাবে

 

আগেই বলেছি বিশ্বনাথের কবিতায় ছন্দ নিয়ে তেমন কারুকাজ দেখা যায় না। কিন্তু এই কবিতাটিতে অন্ত্যমিল ব্যবহারের কৌশল এবং একটি ক্ষেত্রে ছন্দপতন এড়াতে বেছে নেওয়া শব্দ পারম্পর্য পাঠকের সন্ধানী চোখের জন্য উপহারস্বরূপ। প্রথম ও চতুর্থ, এবং দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ পংক্তির অন্ত্যমিল, স্পষ্টত অসমাঙ্গ ও দূরবর্তী, কবিতাটির উচ্চারণগত রহস্য নির্মাণে ভূমিকাবহ।


আলো

উজ্জ্বল বিভ্রম আলো নিয়ত অচেনা

যখন তরঙ্গ ভাবি তখনই কণা

 

নগ্নতা আগুনঘেঁষা, জ্বলে পুড়ে খাক

হাত-পা-লিঙ্গাদি অন্তরালে থাক

 

চক্ষু দুটি? কী হবে ভূমিকা?

আগুনের বৃত্তে যথা ডানাময় পোকা?

 

বিশ্বনাথের এই নির্মাণ বাংলা কবিতার চলমান ধারাতে কোনো নতুন সংযোজন নয়। কিন্তু ভিন্নস্বরের উপস্থিতি প্রথম বইতেই স্পষ্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যতিচিহ্নহীন কবিতাগুলির মূল ব্যঞ্জনা কূটাভাসে। কূটাভাস তৈরির প্রবণতা কবিতাগুলোকে open ended হতে সাহায্য করেছে। প্রসঙ্গত একটা নিটোল/গোটা কবিতার খোঁজ সেভাবে পাওয়া যায় না বিশ্বনাথের অধিকাংশ লেখায়, বরং প্রত্যেকটা কবিতাই তার উচ্চারণের স্বল্পতা দিয়েই টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভাবনার সেই indefinite এলাকায় যা চিন্তাশীল মানব সভ্যতা নিজের বলে ধরে নিয়েছে।

বিশ্বনাথের কবিতায় উন্মুক্ত সমাপ্তির (open endedness-এর) সর্বোচ্চ মানের উদাহরণ তাঁর মিশ্রপ্রতিক্রিয়া সিরিজের কবিতাগুলিতে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে কিছু কবিতা উদ্ধৃত করব।


বাংলা কবিতায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রসঙ্গ বেশ পুরনো ও বহুলপ্রচলিত। প্রতিষ্ঠান বিরোধী কি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নয় সেই ধারণাটি মূলত ঠিক হয়ে এসেছে কবির ব্যক্তি আচরণের উপর ভিত্তি করে। কোনো বিশেষ পত্রিকা, বা বাজারী কাগজের ছত্রছায়ায় কবিতা লিখলে (প্রকাশ করলে), কিম্বা সরকারী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ও সরকারী পুরস্কার গ্রহণকে কেন্দ্র করে কবিকে প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যথা হলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী এরকম একটা চালু ধারণা বাংলা কবিতা-জগতে প্রতিষ্ঠিত। কবিতার বিষয়বস্তু বা উচ্চারণ তথা ভাষাব্যবহারে Institution বা প্রতিষ্ঠিত কাব্যধারা ও ধারণাকে ভাঙার বিষয়টিই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মূল চালিকাশক্তি হওয়া উচিত এমন ভাবনা চালু-আলোচনায় তেমন চোখে পড়ে না। বিশ্বনাথ পুরকাইত মূলত দ্বিতীয় কারণেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী। ক্ষমতা তথা প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর স্বর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই স্পষ্ট।

প্রথম বইয়ের একেবারে শেষ কবিতাতেই তারটি বাঁধা হয়ে যায়, যা পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলির (বিশেষত শেষ তিনটির) মূল উপজীব্য।

চরমপত্র


কোথায় লুকোবে শয্যা

আমি প্রয়োজনে ঠিক ঘুমিয়ে আসবো


দহন সম্পূর্ণ প্রায় এখনও কাতর


যত্নে বুকে জমাও পাথর

এভাবে নদী লুকানো যায়!


ঋতুহীন আমি ভীষণ মরিয়া


উল্টো স্রোতেও অথৈ ভাসব

 


বিশ্বনাথের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শান্তি শৃঙ্খলা’ শুরু হচ্ছে এইভাবে—

 

শান্তি ও শৃঙ্খলা শব্দদ্বয় কতদিন একসঙ্গে আছে

সফল বিবাহ আপত্তি করে না কেউ

আগুনের বৃত্ত ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে যে সব পাতারা

সাদা পোশাকের হাওয়া ঘাড় ধরে আবার আগুনে ফেলছে

শান্তিশৃঙ্খলার নামে

 

আমাদের বহুপরিচিত শব্দবন্ধ নিয়ে শ্লেষের পাশাপাশি জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় কবিতাটি। বিশ্বনাথের এই বইটি অপেক্ষাকৃত খোলামেলা, আলগা, খেয়ালি বাতাসের মতো; নানা ধরণের কবিতার সংকলন।


যাপন

 

ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত, ঘুরে ফিরে গাছতলা

মহাপ্রাণ গাছ

আমাদের যাবতীয় কাজে

শুকনো কাঠের এত প্রয়োজন কীভাবে যে বোঝে!

যথার্থ গভীরে গেলে রন্ধনপ্রণালী

মর্মে গেঁথে দেয় স্বাদ

পাতার বিছানা ক্রমে অভিজ্ঞান, পুরু

চিতার উপরে শুয়ে লাশেদের শালা কি রোয়াব

 

‘লাশেদের শালা কি রোয়াব’ উচ্চারণেই লাশগুলো জ্যান্ত হয়ে গেলো! ‘শালা’ ও ‘রোয়াব’ শব্দের এই ব্যবহারই মনে করিয়ে দেয়, শব্দের মানে তো অভিধানে আছেই, কিন্তু শব্দকে অভিধান থেকে কতদূর টেনে নিয়ে ব্যঞ্জনাময় করে তোলা যাচ্ছে সেটাই দেখার। বিশ্বনাথের কবিতা এখানেই আলোচ্য। বর্ণনা-প্রবণতাকে তিনি সম্পূর্ন বাতিল করতে পেরেছেন তাঁর লেখায়। শব্দ ব্যবহারে, ঝঙ্কার থেকে, কবিতা কবিতা গন্ধ থেকে দূরে সরে নতুন ব্যঞ্জনা তৈরিতে প্রতিটি পৃষ্ঠায় তাঁর উচ্চারণ বৌদ্ধিক সাধনার ইঙ্গিতবহ।

আগেই বলেছি কূটাভাস বিশ্বনাথের কবিতার অন্যতম ভরকেন্দ্র। ‘আকাশপাতাল’ কবিতাটি এখানে দেওয়া হলো—

নগন্য প্রয়াসও শেষাবধি প্রাণান্তিক

নিশ্ছিদ্র বিশ্রামেও হাতে সুদীর্ঘ তালিকা

এ’সময় কীরকম খাদ্যাভ্যাস ভালো

আদর্শ সঙ্গম জাগরণে অসম্ভব জ্ঞানে

শিয়রে দুধের গ্লাস ঘুমিয়ে পড়েছি

 

বিশ্বনাথের কবিতায় পর্যবেক্ষণশক্তি এত জোরালো, আর তা খুব সহজে ধরেছেন তাঁর ‘সম্পর্কজনিত’ নাম্নী কবিতাগুলিতে।

সম্পর্কজনিত—১

সাধারণ রৌদ্রালোকে একটি পাথর

পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল

অথচ অধিকতর দাহ্য খড়কুটো, মানুষাদি

নিরাপদ আনন্দপ্রবণ

 

কীভাবে এমন হয়?

ভিতরে আগুন ছিল? ক্ষয়?

 

তদন্তে প্রকাশ

আর একটি পাথরের কাছাকাছি এসে

এই সর্বনাশ

 

‘বাঁশবন’ নামের এক আশ্চর্য সিরিজ আছে ‘শান্তি শৃঙ্খলা’ বইটির শেষভাগে।

সামান্যই পথ

পথে বাঁশবনহেতু দীর্ঘ মনে হয়

দ্বিতীয় যে পথ আছে আরো ঘুরে ঘুরে

 

বাঁশ বৃক্ষ নয়, তৃণ, কত আগে জেনেছে মানুষ!

 

জটিলতা তবুও

বন না বাগান বলব সিদ্ধান্ত হলো না

পথের বক্রতা নিয়ে তর্ক অন্তহীন

 

 

এতক্ষণে, আশা করি, পাঠককে বাংলা কবিতার যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তার একজন যথার্থ উত্তরসূরীর সঙ্গে পরিচয় করাতে পেরেছি। এলিয়ট কবিতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষতার কথা বলেন : Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things.

বিশ্বনাথের কাব্যিক পর্যবেক্ষণ যেন এলিয়টের এই উচ্চারণের যথার্থ উদাহারণ। কোথাও ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য নেই, বস্তুত ‘আমি’র উপস্থিতিই কবিতাগুলির নৈর্ব্যক্তিক উচ্চারণের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে।


শ্লেষ, কূটাভাস, ভাষা ও বিষয়বস্তুতে ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বনাথের কবিতাগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘খণ্ডচৈতন্য’ পাঠ এক অনুপম অভিজ্ঞতা বইকি।

সময়, গাণিতিক সমস্যা, যুক্তিবোধ, ইতিহাসবোধ, এমনকি বিবৃতি-ধর্মিতা তাঁর কবিতাকে ভারী করে না, বরং রসপূর্ণ উপস্থাপনায় তা কবিতা হয়ে ওঠে।

 

‘খণ্ডচৈতন্য’র প্রথম লেখা—

বর্তমান বা ভবিষ্যে যেভাবে তাকানো যায় অতীতে যায় না। মাড়িয়ে আসা পথে কল্পনা অচল; অভিজ্ঞতাও একা দাঁড়াতে পারে না। যেখানে পায়ের ছাপ ভাবা গিয়েছিল দেখা যায় হাওয়া কখন সব মিলিয়ে দিয়্যেছে

 

ফিরে যাওয়া বরং সম্ভব। দূরে-দুর্গমে পুরনো শত্রুর সঙ্গে দেখা তো হতেই পারে বেড়াতে গিয়ে

 

বা তাঁর উচ্চারণ, ‘নামে মাত্র খেয়া আড়াআড়ি, স্রোত হোক হাওয়া হোক কিছুটা ঘোরাবে’

সভ্যতা, রাষ্ট্র, সমাজ ব্যক্তির উপর যে নিয়ন্ত্রণ, যে দখলদারি ফলায়, যে কায়েমি স্বার্থের উপর দাঁড়িয়ে থাকে সমাজ-সভ্যতা তথা রাষ্ট্র, তার ভিত্তিই অবদমন, ক্ষমতা প্রয়োগের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। আর সেদিকেই তাক করে কামান দেগে দেন বিশ্বনাথ তাঁর উচ্চারণে, ‘…ট্রামলাইনকে সাপ বা অন্য কিছু ভাবিনি কখনো; বিষণ্ণতা দূর করার লক্ষ্যে রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠার পরও আমি বিষণ্ণ থাকতে পেরেছিলাম।’

লক্ষ্যণীয়, বিশ্বনাথের কবিতায় পৌরাণিক গল্প বা চরিত্রের উপস্থিতি নেই। নেই ক্লিশে উপমা ব্যবহারের প্রবণতা। যেন সেই ঘোষণাই পাওয়া গেলো, ‘…ট্রামলাইনকে সাপ বা অন্য কিছু ভাবিনি কখনো…’

একদিকে নাস্তি, অন্যদিকে মূল্যবোধের প্রতি অকুণ্ঠ বিদ্রুপ, অস্তিত্বের আমৃত্যু আর্তনাদ ও ক্ষমতার সামনে নুয়ে না পড়া উচ্চারণ—

ও! কোনো ভাঙনই সম্পূর্ণ হয় না, কেন?

এমনকি ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে যে বসে রয়েছে তার পক্ষেও সম্ভব নয় কোনো কিছুকে শূন্য করে দেওয়া। একই বাক্যে অনন্ত ভাঙনের চিরকালীন আর্তনাদ, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো ভাঙনপ্রক্রিয়াই যে সম্পূর্ণ হয় না তার বিস্ময়!

আমাদের জীবন কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েও সন্ত্রাস-জর্জর হয়তো সেই কথাও এসেছে কবিতায়—

ভিকিরি এলে খুচরো না থাকার ভয়, রেজিস্ট্রি এলে সই কেঁপে যাওয়ার ভয়।

আর রয়েছে কত ছোট্ট পর্যবেক্ষণ—

ভুলে যাওয়া শেখানোর কোনো স্কুল নেই কেন গোপালদা ? আপনি তো রবারকেও অঙ্কনসামগ্রী মনে করেন

কবির প্রথম বইয়ের শেষ কবিতাটি উল্টো দিক থেকে দেখার যে তারটি বেঁধেছিলো, দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় বইতে এসেও উচ্চারণের ঋজুতা আরো বেড়ে গিয়ে, আরো নির্মেদভাবে সেই সুরই যেন নানাভাবে উদযাপিত হচ্ছে।

তাঁর একটা কবিতার শেষ দুলাইন—

‘তোমাকে পাব না আমি জানতাম

আমাকে পাবে না তুমি—জানতে ?’

 

বা তিনটি সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন বাক্য শুধুমাত্র গাঠনিক যুক্তিতে পাশাপাশি বসে যাচ্ছে, সঙ্গে কী তীব্র কৌতুকবোধ—

পর্নোগ্রাফি ছেড়েও দেখেছি ঘুম নেই তদুপরি

ক্রাইম নিষিদ্ধ হল আমাদের গ্রামে

নাম পালটে কত বিষ ওষুধ হয়েছে

তুমি পারলে না?

 

এই বই থেকে আর একটি কবিতা তুলে দিয়ে বিশ্বনাথের কবিতা ভুবনের অন্য আরেক দিকের ইঙ্গিতটুকু রেখে গেলাম—

শরীরে শরীর রেখে টালবাহানা করো

নাম নাও ঠাকুরের, ভাগ্যধর আমি

উদ্গমেই গুরু পেয়ে যাই

 

আজ গুরুপত্নীর কোলে বড় হচ্ছে আমার সন্তান

গোপন রাখারই নির্দেশ যদিও এই সুসমাচার

প্রিয় খেজুর গাছটিকে বলে যেতে চাই

 

Openendedness-এর সর্বগ্রাসী ব্যবহার দেখা যায় বিশ্বনাথের মিশ্রপ্রতিক্রিয়া নাম্নী সিরিজের কবিতায়। সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু তুলে দিচ্ছি এখানে।

একটি কবিতার শেষ অংশ—

‘শব্দ হচ্ছিল, যন্ত্রণা জন্ম নিচ্ছে, সান্ত্বনা জন্ম

নিচ্ছে; নিচে ভাষার পলেস্তারা, উপরে আলোর

দাপাদাপি, যন্ত্রণা থিতু হতে পারছে না, সান্ত্বনাও অস্থির

 

একটিই শব্দবন্ধ শুধু এখানে পাঠকের নজরে আনবো, ‘সান্ত্বনাও অস্থির’

এই সিরিজের প্রায় অধিকাংশ কবিতাই গদ্যে লেখা। আরো একটি কবিতার অংশবিশেষ—

তুমি স্থির থাকলে আমার দৌড় ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছত। বিকল্পে, আমিই দাঁড়াচ্ছি তবে। পথ হারানোর কথা ভোলো; গ্রহণে-বর্জনে আতঙ্ক সমান, ভোলো

 

এবার একটি গোটা কবিতা তুলে দিই—

তুমি বেড়াতে ভালোবাসো বলে আমি টাইম-টেবিল পড়ছি। রাত্রি। সংখ্যা ও অক্ষরকুচির উপর নিসর্গের হিম জমে আছে। কী অসম্ভব গতি! কত অচেনা আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জানলার কাচে, সরে যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে। একটা সাদামাটা স্টেশনে তুমি নামতে চাইলে। ঘুম নেমে এল

নিছক প্রকৃতি বর্ণনার বাইরে দাঁড়িয়ে বিমূর্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এমন ম্যাজিক তৈরিতে বিশ্বনাথ রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের সার্থক উত্তরসূরি—‘…সংখ্যা ও অক্ষরকুচির উপর নিসর্গের হিম জমে আছে…’।

প্রায় আকাশবাণীর মতো উচ্চারণ, ‘এ বছর গ্রামবাংলা বিখ্যাত হবে। ভবিষ্যদ্বাণীর মতো শোনালেও তৈরি থেকো। খেজুর গাছের নিচে যেয়োনা। দূর থেকে দেখো যাবতীয় হলুদ।’

আর এই নাছোড় উচ্চারণ—

যত দিন না বিপর্যয় ব্যাখ্যাতীত হচ্ছে

আনন্দের ভাবধারা থেকে একতিলও নড়ছি না

 

বিষাদের যথাযথ ভাষা আনন্দেরও উৎস

 

বেশি পিছনে যাওয়া অসম্ভব তাই তোমাকে আঁকড়াই

 

‘ভাষাবাহিত রোগশোক’ কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে ‘খণ্ডচৈতন্য’ কাব্যগ্রন্থের সম্প্রসারণ। এবং তার যাথার্থ্য দুটি বইয়ের শীর্ণকায় অবয়বেই রয়েছে। বারো বছরের ব্যবধানে কবি আবার নিজের অতীত উচ্চারণ নতুন মহিমায় তুলে আনেন--

পরমাণুও অবিভাজ্যও নয় জেনে ভয়

বাড়ে—যারা ভাঙন সহ্য করতে পারে না

তাদের কী হবে

 

এই বইতেই রয়েছে, ‘নিজের ঘুমন্ত মুখ—প্রিয় দৃশ্য—দেখি বারবার।’

এই যে ‘অমোঘ’ বলে একটি শব্দ রয়েছে তার অসারতা, অন্যদিকে সম্ভাবনার উন্মুক্ততার ঘোষণা এইভাবে উচ্চারিত হয়—

সমুদ্রদর্শনের স্মৃতিও ফিকে হয়ে যাবে—

এই বাক্য লিখে শুয়ে পড়ি।

সমুদ্রের বদলে পাহাড়-জঙ্গল-হাতিঘোড়া লিখলেও

অন্যথা হতো না।

 

একটি কবিতায় রয়েছে ‘ভুলে যাই চলো পুরনো অতীত’। ‘অতীত’ শব্দটির আগে বসানো ‘পুরনো’ বিশেষণ অবাক করে না? তবে কি এই শবদবন্ধ ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের ইঙ্গিতবাহী? নতুন ন্যারেটিভ দিয়ে পূর্বের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস যেভাবে ভোলানো হয়, বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ম্যানুফ্যাকচার্ড ন্যারেটিভ যখন নতুন ইতিহাস নির্মাণের দাবী রাখে, এই আপাত সাধারণ শব্দবন্ধ রচিত যেন সেদিকেই তাক করে।

 

এহেন কবি বিশ্বনাথ পুরকাইত আপামর কবিতা পাঠকের কাছে তেমন পরিচিত নন। এর জন্য কে দায়ী? কেউ না। অনেকেই বলেন, অমুক কবি নিভৃতচারী, আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন। এসব কথা অত্যন্ত অর্থহীন। কবি যদি নিজের কবিতা প্রচার করেন তাতে যেমন দোষ নেই, তেমন কবিতা লেখা এবং গ্রন্থবদ্ধ করাটুকুই যিনি একজন কবিতা রচয়িতা হিসেবে কাজ মেনেছেন তাঁর ভুল কোথায়! কবিতা নিভৃতে, আড়ালেই হয়।

আলোচনা প্রসঙ্গে আরো দু’জন কবির সঙ্গে বিশ্বনাথ পুরকাইতের উদ্দেশ্যে সমালোচক ও চলচিত্র-বোদ্ধা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “মিডিয়া পার হয়ে গেলে যে প্রত্যন্ত প্রদেশ থাকে, যাকে শাহরিক সংস্কৃতির মফঃস্বল বলা যায়, সেখানে কোন কোন কবি শীর্ণ তপস্বীর মতো আবৃত্তিকার থেকে দূরে, কবিতার র‍্যাম্প থেকে দূরে সরে গিয়ে, চৈত্রের চরাচরে একাকী দগ্ধতরুর মতো কৃশকায় হয়ে সময়ের সাক্ষী হয়।”

আর কবি বলছেন—

একজন দু’জন করে পাঠক বাড়ছে কবির, কেউ কেউ

বিশিষ্টও, ভয় হয় ওরাই কবিকে খাবে। তার আগে

চলো যে দেশে শিক্ষকতা নেই, সংস্কৃতিমনস্ক হাঁ ও জটিলতা

নেই, কবি আছে, ঘুমোয়

 

পুনশ্চ : সদ্যপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঘটনাচক্রে’ নিয়ে কিছু লিখলাম না, বা কোনো কবিতা তুলে দিলাম না। নতুন কবিতার বই আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। বিশ্বনাথের মিশ্রপ্রতিক্রিয়া তুলে দিয়েছি এমন অনেকের হাতে যারা কবিতার বই আলোচনা করেন দিস্তে দিস্তে, কানে কানে বিশ্বনাথ সম্বন্ধে 'অসাধারণ' অভিধা দিয়ে লেখেন তাদের নিয়ে যাদের বই সমালোচনা করলে নিজের পাঠকবৃত্ত বা ইত্যাদি-প্রভৃতি বাড়বে। বাড়ুক। শুধু বলব বিশ্বনাথকে পড়ুন। মেদবর্জিত কবিতার দিকে কয়েক পা এগোন।

বিশ্বনাথ পুরকাইতের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ

নিম্নচাপের দিনগুলি, প্রকাশক-পত্রপুট, ১৯৯৮ (৪৮ পৃষ্ঠা)

শান্তি শৃঙ্খলা, প্রকাশক-পত্রপুট, ২০০৩ (৪৮ পৃষ্ঠা)

খণ্ডচৈতন্য, প্রকাশক-অফবিট, ২০০৬ (১৬ পৃষ্ঠা)

মিশ্রপ্রতিক্রিয়া, প্রকাশক-মুক্তাঞ্চল, ২০১৩ (৩২ পৃষ্ঠা)

ভাষাবাহিত রোগশোক, প্রকাশক-ভাষালিপি, ২০১৮ (২২ পৃষ্ঠা)

ঘটনাচক্রে, প্রকাশক—মুক্তাঞ্চল (১৬ পৃষ্ঠা)


...........................................................................


            বইয়ের বিজ্ঞাপন



 

Comments

  1. খুব ভালো লিখেছ প্রশান্ত । কবিকে প্রণাম । আমার সৌভাগ্য যে, আমার কাছে তিনি একান্ত অপরিচিত নন ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সরসিজ বসুর সাক্ষাৎকার। স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত

তদোগেন গিরতের 'যে কথা মরমে বাজার নয়'

প্রশান্ত হালদারের কবিতা—জন্মদিনে মদ খাও বন্ধুরা