শার্ল বোদল্যেরের প্রবন্ধ—অনুবাদ : শুভদীপ মৈত্র

 












শিল্পী, দুনিয়াদার, ভিড়ের একজন, এবং শিশু


শার্ল বোদল্যের


অনুবাদ: শুভদীপ মৈত্র


[ অনুবাদকের নিবেদন:- শুধু কবিতা নয়, শার্ল বোদল্যের-এর প্রবন্ধ আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণের যেমন চাবিকাঠি তেমনি তা উনিশ শতকের আধুনিকতার সময়কাল সন্ধানের মাইলফলকও। এই অনুবাদটি ‘দা পেইন্টার অফ মডার্ন লাইফ বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধগুলো বোদল্যের ১৮৬০ নাগাদ লেখান ও ১৮৬৩ নাগাদ লে ফিগারো পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। 
   দেড়-শ বছরেরও পুরনো এই বইটি আজও আমাদের সময়কে বুঝতে সাহায্য করে কারণ পুঁজিবাদী আগ্রাসনের মুখে বুর্জোয়া সমাজ ও তার নাগরিকতা, সে সময় দাঁড়িয়ে শিল্পের অভিমুখ কী হতে পারে এই সমস্ত জরুরি প্রশ্নগুলো প্রথম তোলেন বোদল্যের, এরপর ভাল্টার বেঞ্জামিন-এর মতো দার্শনিক ও তাত্ত্বিকরা একে এগিয়ে নিয়ে যান, তাই বোদল্যের এর ফ্ল্যান্যুর বুঝতে না পারলে নিজেদের সময়কে বোঝাও কঠিন। বাংলায় বোদল্যের চর্চা আজকের নয় কিন্তু তাঁর নান্দনিকতার রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোতে নজর পড়েছে কম, বরং তার ব্যক্তি-উৎকেন্দ্রিকতার রোমান্টিসিজমের উদযাপন হয়েছে বেশি। বোদল্যের মেধাহীন স্বভাবকবি নন বরং সুচিন্তিত সমালোচক নাহলে দেলাক্রোয়া থেকে শুরু করে সমকালীন শিল্পী সাহিত্যিকদের নিয়ে পাতার পর পাতা লিখতেন না, এই কথাটা বারবার মনে করা দরকার। আবার এটাও সত্য যে কোনো বিশেষ সমাজ ও রাজনৈতিক আন্দোলন বা মতবাদের চশমায় বোদল্যের-এর সমাজবীক্ষা নয়, যা আমাদের সময়ের ব্যাধি ও ব্যবসা।
 এইসব কথা মাথায় রেখে বইটার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ অনুবাদ করা। যথেষ্ট মূলানুগ করতে গোটা তিনেক অনুবাদ ও অভিধান হাতে এ অনুবাদ করলাম। ফরাসী ভাষা না-জানার সমস্যা যেমন আমার আছে তেমনি এটাও সত্যি যে অনুবাদের সবচেয়ে বড় বাধা শব্দার্থ নয়, লেখকের শব্দপ্রয়োগ সম্পর্কে সাংস্কৃতিক জ্ঞান থাকা, এবং সংস্কৃতির বিষয়ে একটা এনসাইক্লোপেডিক জ্ঞান প্রয়োজন। আমার সামান্য ক্ষমতায় সেই বিশাল কাজ সম্ভব নয়, আমার অভিসন্ধি এই চর্চাকে সামান্য হলেও যদি উসকানো যায় এই পর্যন্ত। বাকিটা পাঠকের হাতে।  ]


[ মুক্তাঞ্চল : শার্ল বোদল্যেরের 'আধুনিক জীবনের চিত্রকর ও অন্যান্য প্রবন্ধ' বইটির এটি তৃতীয় প্রবন্ধ। উনিশ শতকের ফরাসি চিত্রকর কনস্তানতিন গি-র চিত্রকলা নিয়ে এই প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদকৃত নাম The Artist, Man of the World, Man of the Crowd, And Child.   ]


জ আমি পাঠকদের এমন একজন ঐকিক মানুষের কথা বলতে চাই যার কাজ মৌলিকতায় এত স্পষ্ট ও শক্তিশালী যে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অন্য কারো অনুমোদনের তোয়াক্কা করে না। তাঁর কোনো আঁকাই সই করা নয়, সই বলতে যদি কয়েকটা অক্ষর বোঝায়, যা সহজেই নকল করা যায়, যেগুলো পাশাপাশি বসে নামটা তৈরি হয় এবং বহু শিল্পী তা খুব গর্বের সঙ্গে তাদের অতি তুচ্ছ কাজের তলায়ও বসিয়ে দেন। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিটা ছবি নিজস্ব আত্মার ঔজ্জ্বল্যে স্বাক্ষরিত, এবং আমার বর্ণনা থেকে যে কোনো সাধারণ শিল্প-রসিক তাঁকে চিনে নিতে পারবেন



কনস্তানতিন গি (১৮০২-১৮৯৫)

একই সঙ্গে জনারণ্যর এবং একান্তের প্রেমিক মঁসিয়ে সি.জি তার মৌলিকতাকে প্রায় বিনয়ে পরিণত করেছেন। মি: থ্যাকার,  যাকে আমরা চিনি একজন শিল্প রসিক হিসেবে এবং নিজের উপন্যাসের অলংকারক হিসেবে, তিনি লন্ডন রিভ্যুয়ের কলামে ম. জি-কে নিয়ে কিছু কথা লেখেন। তাতে ম. জি এমন বিরক্ত হন যেন তার উপর জুলুম করা হয়েছে। সম্প্রতি তিনি যখন জানতে পারেন আমার মাথায় ঘুরছে তার মন ও প্রতিভা নিয়ে লেখার কথা, তিনি অনুরোধ করেন  বলতে বাধ্য হচ্ছি খুব রাসভারীচালেই  যে তাঁর নাম যেন গোপন করা হয়, এবং তাঁর কাজ নিয়ে আমি কথা বলি এমনভাবে যেন অনামা শিল্পীর কাজ। আমি খুব বিনীতভাবে তাঁর এই অনুরোধ রক্ষা করতে চাই। তাই পাঠক, আমরা ধরে নিচ্ছি ম.জি বলে কারো অস্তিত্ব নেই। আমরা তাঁর ড্রয়িং ও জলরঙের কাজগুলোর প্রতি মনোযোগ দেব (যেগুলোর প্রতি তাঁর এক প্যাট্রিশিয়ান নাক-কোঁচকানো রয়েছে) এমনভাবে যেন কোনো বিশেষজ্ঞর হাতে কোনো ঐতিহাসিক নথী এসে পড়েছে যার রচিয়তার নাম চিরকাল অজানা থাকবে। এবং আমার বিবেককে আশ্বস্ত করতে, আমাকে ধরে নিতে হবে তাঁর এই অদ্ভুত রহস্যময় রকমের চরিত্র সম্পর্কে আমার ধারণা তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র ওই কাজগুলো থেকে  ফলে তা খাঁটি কাব্যিক অনুমান, আন্দাজ ও কল্পনার ফসল মাত্র।



গি'র পেইন্টিং 'সুলতানস ক্যারেজ' 

ম. জি-র বয়েস হয়েছে, শোনা যায় জ্যা-জ্যাক লেখা শুরু করেন বেয়াল্লিশ বছর বয়সে, বোধহয় একইরকম বয়সে ম. জি মাথার ভিতর গিজগিজ করতে থাকা ছবি নিয়ে পাগলপারা হয়ে সাহস করে শাদা কাগজের পাতার উপর রঙ ও কালি ছুঁড়তে শুরু করেন। সত্যি কথা বলতে কী তিনি তখন আঁকতেন বর্বরদের মতো বা বাচ্চাদের মতো, তাঁর অপটু আঙুল আর অবাধ্য সরঞ্জামকে সরোষে দুষতে দুষতে। আমি এই আদিম কালি-লেপন প্রচুর দেখেছি এবং স্বীকার করে নিচ্ছি যাঁরা এ বিষয়ে রসজ্ঞ বলে খ্যাত তাঁরা এইসব কালি-মাখা ছাপছোপের মধ্যে কোনো সুপ্ত প্রতিভা খুঁজে না পান তাদের বেশিরভাগকে ক্ষমা করে দিতে হবে  আজ ম. জি তাঁর শিল্পের কলাকৌশল নিজে-নিজে অন্যের সাহায্য ছাড়াই খুঁজে পেয়ে তাঁর নিজের মতো করে একজন ওস্তাদ, এবং তাঁর শুরুর যে সৌকর্যহীনতা তা তিনি অটুট রেখেছেন শুধুমাত্র ততটুকুই যা তাঁর কাজের প্রতিভার মধ্যে অপ্রত্যাশিত মশলা হিসেবে দরকার। কোনোভাবে তাঁর এই প্রথম দিকের কাজগুলোর মুখোমুখি হলে যেভাবে ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে ফেলেন, সেই সময় তাঁর রাগ ও লজ্জার অভিব্যক্তি দেখবার মতো

দশ বছর ধরে আমি সেই  দারুণ ভ্রমণার্থী ও নাগরিক ব্যক্তিত্ব ম. জি-র সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। আমি জানতাম তিনি বহুদিন ধরে একটা ইংরেজি ইলাস্ট্রেটেড পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এবং সেখানে তাঁর ভ্রমণের (স্পেন, তুরস্ক, ক্রিমিয়া) স্কেচের এনগ্রেভিং থেকে ছবি ছাপা হয়েছে তখন থেকেই আমি তাঁর অনেক ছবি দেখেছি, যা অকুস্থলে আঁকা। বলতে গেলে ক্রিমিয়া অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ আমি যা ‘পড়তে’ পেরেছি তাঁর ছবি থেকে, অন্য কারোর বর্ণনার তুলনায় তা ঢের ভাল। এই পত্রিকাই তাঁর আঁকা প্রচুর নতুন নতুন ব্যালে ও অপেরার ছবিও ছেপেছিল, যথারীতি সই ছাড়া। তা শেষ পর্যন্ত যখন তাঁকে আমি এই মর্ত্যভূমিতে পাকড়াও করতে পারলাম, বুঝলাম আমি কারবার করছি একজন শিল্পীকে নিয়ে নয় বরং অনেক বেশি এক দুনিয়াদারকে নিয়ে। এ প্রসঙ্গে বাঞ্ছনা করব ‘শিল্পী’ শব্দটা আমি ক্ষুদ্র অর্থে এবং ‘দুনিয়াদার’ শব্দটা বৃহৎ অর্থে ব্যবহার করছি ধরে নিতে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমি বোঝাতে চেয়েছি এক সম্পূর্ণ সার্বজনিক মানুষের কথা, এমন একজন মানুষ যিনি জগতটাকে এবং সে জগতের সমস্ত রহস্যময় ও ন্যায্য যুক্তিপূর্ণ আচরণগুলোকে বোঝেন; আর শিল্পী বলতে আমি বুঝিয়েছি এমন এক বিশেষজ্ঞকে যিনি তাঁর প্যালেটের সঙ্গে যুক্ত, যেভাবে একজন ভূমি-দাস যুক্ত তার জমিতে . জি পছন্দ করেন না তাঁকে কেউ শিল্পী বলে ডাকুক। একভাবে তিনি কি ঠিক নন? তাঁর উৎসাহ গোটা পৃথিবীটাকে নিয়ে; তিনি জানতে, বুঝতে ও উপভোগ করতে চান এই গোলকের উপর যা কিছু হচ্ছে তাকে। রাজনীতি ও নৈতিকতার পৃথিবীতে শিল্পীরা খুব কম যাপন করে, যদি আদৌ করে তো যদি ব্রেদা জেলার লোক হয় তবে সে নিশ্চিতভাবে ফ্যাবুর্জ বা স্যাঁ জার্মেন-এ কী ঘটছে তার সম্পর্কে অন্ধকারে থাকবে। তাই এটা স্বীকার করতেই হবে যে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ শিল্পীই একজন দক্ষ-জন্তু ছাড়া আর কিছু না। তারা বিশুদ্ধ শ্রমিক, গেঁয়ো ভূত, যাদের মাথা কুঁড়েঘরের মতো ছোট, তাদের কথোপকথনের বিষয়ও একটা সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকে ফলে তা একজন দুনিয়াদারের কাছে একজন উদ্দীপ্ত নাগরিকের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।

সুতরাং ম. জি-কে চিনতে গেলে আমি বলব, তার প্রতিভার প্রাথমিক উৎস হল কৌতূহল, এ-কথা আপনারা নোট করে রাখতে পারেন।


গি'র Crowd সিরিজের একটি


আপনাদের একটা ছবির কথা মনে আছে (ছবি ছাড়া আর কী সেটা!), এসময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী কলমের লেখা, ‘ম্যান অফ দ্য ক্রাউড’? ক্যাফেতে বসে একজন সদ্য-আরোগ্যপ্রাপ্ত মানুষ সানন্দে উপভোগ করছে বাইরের ভিড়, আর মন মিশে যাচ্ছে আশপাশ থেকে উঠতে থাকা চিন্তার ঢেউগুলোর মধ্যে। সদ্য মৃত্যুর ছায়া থেকে বেরিয়ে সে যেন শুষে নিতে চায় পৃথিবীর সব স্বাদ ও গন্ধ; যেন সে স্মৃতিভ্রষ্ট হবে, তার আগে স্মরণ করতে চায় এবং তীব্রভাবে রোমন্থন করতে চায় সব কিছু। শেষ পর্যন্ত সে বাইরের সেই জটলার মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে ছুটে যায় অপরিচিত এবং আধো-দেখা এক মুখের পিছনে যার তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎ তাকে মুগ্ধ করেছে। কৌতূহল তার কাছে এক অপ্রতিরোধ্য আবেগ হয়ে উঠেছে তখন।

এখন কল্পনা করুন এমন একজন শিল্পীকে যার আত্মা সারাক্ষণ এই মুর্ছোত্থিত অবস্থায় আছে, তাহলেই ম. জি-কে বোঝার চাবিকাঠি পেয়ে যাবেন।

এই অবস্থাটা অনেকটা দ্বিতীয় শৈশবের মতো। একজন মুর্ছোত্থিত যে কোনো জিনিসের, এমনকি একেবারে সাদামাটা হলেও, প্রতি কৌতূহলেও চূড়ান্ত আনন্দ পায়, অনেকটা বাচ্চাদের মতো। আমরা যদি মনে করি একেবারে বাল্যের প্রথম স্মৃতিরেখগুলোয় তাহলে দেখব তার সঙ্গে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক আছে নিরাময় পরবর্তী স্মৃতিরেখর সঙ্গে, যদি না অসুখ আমাদের আত্মিক ক্ষমতার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে দেয়। একটা বাচ্চা সবকিছুই নতুন চোখে দেখে; সে সব সময়েই তাতে ‘মাতাল’ রঙ ও আকৃতির মধ্যে বাচ্চারা যে আনন্দ পায় তার মতো অনুপ্রেরণা আর কিছুতেই নেই। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলব অনুপ্রেরণা অনেকটা খিঁচুনি বা তরকা লাগার মতো, প্রত্যেক মহৎ ভাবনা তেমনি একটা জোরালো স্নায়বিক উত্তেজনা তৈরি করে যা আমাদের সেরিব্রাল কর্টেক্সে ধাক্কা দেয়। জিনিয়াসের স্নায়ু সুদৃঢ়; বাচ্চাদের দুর্বল। প্রথম-জনের কাছে যুক্তি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; অপরজনের কাছে অনুভূতি প্রায় সমস্ত সত্তা  জুড়ে থাকে। প্রতিভা আর কিছুই নয়  সেই শৈশবকে পুনর্ব্যবহার করা ইচ্ছে-মতো, শৈশব যা পূর্ণবয়স্কর প্রকাশ-ক্ষমতায় বলীয়ান, এবং যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে অসেচতনভাবে জোটা সব অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আনা। এই গভীর আনন্দময় কৌতূহল লক্ষ্য করা যায় তাদের চাহনিতে, জন্তুর মতো এক পুলকে অধীর, তারা যখন কোনো নতুন জিনিসের দিকে তাকায়, সে যা খুশিই হতে পারে কোনো মুখ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য, আলো, রঙ, গিল্টি-করা পাত, ভেজা রেশম বা সুচারু পোশাকে সুন্দর শরীর। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন একদিন, ছোটবেলায় তাঁর বাবা যখন পোশাক পরতেন, তিনি উপস্থিত থাকতেন এবং কীভাবে প্রত্যেকবার অবাক ও খুশি হতেন দেখে তাঁর বাবার হাতের পেশিগুলো, চামড়ার রঙের গোলাপি ও হলদে মেশা টোনগুলো আর শিরার নীলচে জাল বিস্তার। বাইরের জগতের ছবি তখনই তাঁর ভিতর শ্রদ্ধা জাগাতে শুরু করে দিয়েছে, তখনই বস্তুর আকৃতি তাঁকে পাগল করে দিয়ে পেড়ে ফেলতে শুরু করেছে। সেই অকালেই তার নাকের ডগায় ফুটে উঠেছিল দুর্ভাগ্যের চিহ্ন, তাঁর অভিশপ্ত জীবন তখন থেকেই নিশ্চিত। আমাকে কি আর বলতে হবে আজ সেই কিশোর একজন বিখ্যাত শিল্পী?

আমি আপনাদের এখন  বলছি ম.জি-কে একজন চির-মুর্ছোত্থিত হিসেবে ভাবতে, তাহলেই তাঁর সম্পর্কে ধারণাটা সম্পূর্ণ হবে। তাকে ভাবুন একজন পুরুষ-শিশু যেন, এমন এক মানুষ যে প্রতি মুহূর্তে শৈশবের প্রতিভার অধিকারী, বা অন্যভাবে বললে এমন প্রতিভা যার জীবনের কোনো প্রান্তই ভোঁতা হয়ে যায়নি।



গি'র Two Women 


আমি তাঁকে বিশুদ্ধ শিল্পী বলতে রাজি নই, এবং তিনি নিজেও তাঁর সেই অভিজাত-সংযমে রাঙানো বিনয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। আমি তাকে ড্যান্ডিই বলতে চাই, তার অনেকগুলো কারণও আছে আমার কাছে। ড্যান্ডি বলতে বোঝায় একইসঙ্গে একদিকে চরিত্রের এসেন্স এবং পৃথিবীর সমস্ত নৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্ম বোধ আবার অন্যদিকে শীতল নির্লিপ্ত অবস্থার আকাঙ্ক্ষা। এই দ্বিতীয় ব্যাপারে ম.জি কঠোরভাবে ড্যান্ডিজমের থেকে দূরে, তিনি দেখা ও অনুভবের ক্ষেত্রে যে-কারো থেকে বেশি আবেগের দাস। সন্ত অগাস্তিন বলেছিলেন  ‘আমাবাম আমারে’ বা আমি আবেগ দিয়ে আবেগকে ভালবাসি। ম.জি যেন তার স্বেচ্ছা-প্রতিধ্বনি। ড্যান্ডি নিরুত্তাপ বা তার ভান করে, কিন্তু পন্থা বা শ্রেণীগত অবস্থান হিসেবে ম.জি নিরুত্তাপদের ঘৃণা করেন। তাঁর শিল্পের এক জটিল ক্ষমতা (পরিশীলিত পাঠক বুঝবেন) রয়েছে হাস্যকর না হয়েও আন্তরিক হয়ে ওঠার। আমি সাগ্রহে তাকে দার্শনিকের খেতাব দিতে চাই যা পাওয়ার অধিকার তার একাধিক কারণে রয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃশ্যমান বাস্তব বস্তুর প্লাস্টিক ফর্মের প্রতি এত বেশি প্রেম যে তাঁর মধ্যে সেই সব বস্তু অপছন্দ তৈরি করে, অথচ একজন মেটাফিজিশিয়ানের অধরা পৃথিবী তৈরির রসদ সেই বস্তুগুলো। তাঁকে তাই নামিয়ে আনা যাক খাঁটি চিত্রানুগ নীতিবাগীশে, লা-ব্রুয়ের-এর মতো।

ভিড় হল তার কার্যক্ষেত্র, যেমন পাখির বাতাস, মাছের জল। ভিড়ের সঙ্গে পরিণয় তার পেশা ও নেশা। নিখুঁত এক ফ্ল্যান্যুর বা উৎসাহী পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রে অপরিসীম আনন্দের ব্যাপার এই সংখ্যাধিক্যের মধ্যে বাস করা, যা গতিময়, আন্দোলিত, পলাতক এবং অসীম। ঘরের বাইরে থেকেও সর্বত্র ঠাঁইয়ের অনুভূতি, জগতটাকে দেখতে পাওয়া, তার কেন্দ্রে থাকা অথচ গোটা দুনিয়ার থেকে গোপনে  এগুলো ন্যুনতম আনন্দ এধরনের স্বাধীন আবেগী ও নিরপেক্ষ মনের – যা ভাষা খুব এলোমেলো ভাবে বর্ণনা করতে পারে মাত্র।

 

গি'র On the Champs-Elyses

সেই পর্যবেক্ষক তখন ছদ্মবেশী রাজকুমারের মতো যে সদাই তার গোপন পরিচয় উপভোগ করছে। জীবন রসিক যেমন পৃথিবীটাকেই তার পরিবার বানিয়ে ফেলে; প্রেমিক যেমন সন্ধানী, সন্ধানে থাকা বা অতীতের সুন্দরীদের নিয়ে জগত বানায়; যেমন চিত্র-রসিক ক্যানভাসের উপর আঁকা স্বপ্নের মোহগ্রস্ত এক সমাজে বাস করে – সেভাবে শাশ্বত জীবন-প্রেমীও ভিড়ের মধ্যে ঢোকে এক প্রকাণ্ড আধারে ধরা বৈদ্যুতিক শক্তির মতো। আমরা তাকে এই জনতার সামনে এক বিশাল আয়নার সঙ্গেও তুলনা করতে পারি; একটা চেতনা-সমৃদ্ধ ক্যালাইডোস্কোপ যা প্রতিবিম্বিত করে বহু জীবন ও জীবনের প্রত্যেক উপাদানের চলিষ্ণু সৌষ্ঠব। এটা না-আমির আমিত্বের না মেটা খিদে  যা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রকাশ করে জীবনের থেকেও জীবন্ত ছবিতে, যা অস্থিতিশীল ও ক্ষণস্থায়ী। “কোনো মানুষ,” ম.জি একদিন কথাবার্তার মাঝখানে বলেছিলেন, যে কথোপকথনগুলোয় তার প্রগাঢ় চাহনি আর উত্তেজিত ভঙ্গিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত, “কোনো মানুষ যদি সেই সব দুঃখের ভারে ন্যুব্জ হয়ে না পড়ে যার বাস্তবতা এতই কঠোর যে তার সমস্ত ক্ষমতাকে অভিভূত করে ফেলে, এবং ভিড়ের মাঝখানে অবসন্ন হয়ে পড়ে, সে একটা মাথামোটা! একটা মাথামোটা! এবং আমি তাকে ঘৃণা করি”

যখন ম.জি ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলেন আর দেখেন ঝলমলে রোদ্দুর তাঁর জানলার কাচে ঝড় তুলছে, তিনি আফসোস আর অনুশোচনার সুরে বলে ওঠেন, “আহ কী প্রতাপ! আলোর কী জমক! কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই চারদিকে কী আলো! আমি ঘুমের মধ্যে হারিয়েছি! অসংখ্য আলোকিত বস্তু আমি দেখতে পেতাম যা আমি দেখিনি!” এবং তিনি বেরিয়ে পড়েন, দেখেন অসাধারণ রাজকীয় এক জীবনীশক্তির প্রবাহ। তিনি তারিফ করেন রাজধানীর জীবনের চিরন্তন সৌন্দর্য এবং বিস্ময়কর ঐকতানকে, যে ঐকতান মানুষী স্বাধীনতার বিশৃঙ্খলার মধ্যেও বজায় আছে। প্রত্যক্ষ করেন সেই বিশাল শহরের ল্যান্ডস্কেপ, যার পাথরের উপর কুয়াশা এই আদরের প্রলেপ বোলাচ্ছে তো সূর্যের রশ্মি এই এসে ধাক্কা মারছে। উপভোগ করতে থাকেন সুন্দর কোচ-গাড়ি, ঘোড়ার গর্বিত চাল, পেজ-বয়দের পরিচ্ছন্নতা, ব্যালেদের দক্ষতা, ছন্দিত মেয়েদের সাজপোশাক, সুন্দর শিশু, ভাল থাকা ও ভাল পোশাকে খুশি এক কথায় শাশ্বত জীবন। যদি কোনো পোশাকের কাট বা ফ্যাশান সামান্যতম বদলায়, যদি রিবনের গিঁটগুলো, কার্লগুলোকে সিংহাসনচ্যুত করে ককেড, যদি ফ্ল্যাপ চওড়া হয়ে গিয়ে থাকে এবং বান যদি ঘাড়ের কাছে একদাগ নেমে আসে, যদি বেল্ট উপর দিকে ওঠে আর স্কার্ট বড় হয়ে যায় — বিশ্বাস করুন বহু দূর থেকে তার শ্যেন দৃষ্টি আগেই অনুমান করে ফেলেছে। যেমন একটা রেজিমেন্ট পাশ দিয়ে গেল, পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যাচ্ছে হয়তো, বুলেভার্ড থেকে আকাশের দিকে আশার মূর্ছনা ছুঁড়ে দিয়ে তার ব্রাস ব্যান্ড থেকে; ম.জি-র চোখ ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে, অস্ত্রশস্ত্র, চেহারা ও শারীরিক গঠন সেই বাহিনীর পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছেন তিনি। সাজসজ্জা, জাঁকজমক, সংগীত, অঙ্গীকারবদ্ধ চেহারা, মোটা ও গম্ভীর গোঁফগুলো তাঁর ভিতরে একত্রিত, এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই এর ফলস্বরূপ যে কবিতা তা তৈরি হয়ে যাবে। এখন তাঁর আত্মা সেই বাহিনীর সঙ্গে একাত্ম, এক জন্তুর মতো হেঁটে চলেছে তাদের একজন হয়ে আনুগত্যের আনন্দে গর্বিত এক ছবির মতো।


গি'র Dandies in the Park

কিন্তু সন্ধ্যা এসে যায়। এক এক অদ্ভুত এবং অনির্ণেয় সময় যখন আকাশের পর্দা নামে আর শহরের আলো জ্বলে ওঠে। সূর্যাস্তের বেগুনি রঙের গায়ে গ্যাসের কলঙ্ক লাগে। সৎ বা অসৎ, পাগল বা টনটনে, সবাইই নিজের মনে বলে ওঠে “শেষ পর্যন্ত দিনটা শেষ হল!” জ্ঞানী বা দুষ্ট সব নাগরিকই আমোদের কথা ভাবে, এবং সকলেই তাদের পছন্দের জায়গায় ছোটে যেখানে পেয়ালায় চুমুক দেবে। ম.জি থাকবেন শেষ পর্যন্ত – যেখানে আলোর উজ্জ্বলতা রয়েছে, কবিতার অনুরণন, জীবনের প্রাচুর্য, সংগীতের ঝংকার; যেখানে যেখানে কোনো আবেগ তার চোখের সামনে আবির্ভূত হয় কোনো ভঙ্গিমায়; যেখানে যেখানে সাধারণ মানুষ গতানুগতিক মানুষ এক কিমাকার সৌন্দর্যে নিজেকে মেলে ধরে; যেখানে যেখানে সূর্য আলোকিত করে ‘বঞ্চিত জন্তুদের’ ক্ষণিকের আনন্দ। “ওহ একটা নিশ্চিত ব্যস্ত দিন” আমাদের চেনা সেই জনৈক পাঠক বলল “আমাদের প্রত্যেকেরই তো সেটুকু বোঝার প্রতিভা আছে।”  না! খুব কম লোকেরই দেখার চোখ থাকে, তার থেকেও আরো কম লোকের সেটা প্রকাশ করার। এখন যখন বাকিরা ঘুমোচ্ছে, তিনি টেবিলের উপর ঝুঁকে, কাগজের উপর সেই দৃষ্টিটা দিয়ে তাকিয়ে যা তিনি আগে দেখা সব দৃশ্যগুলোর উপর ফেলেছিলেন। পেনসিল, পেন, ব্রাশ নিয়ে অসি খেলতে খেলতে, গ্লাস থেকে সিলিংয়ে জল ছেটাতে ছেটাতে, জামায় পেন মুছতে মুছতে  নিঃশেষিত, হিংস্র, সক্রিয় – যেন তিনি আশঙ্কা করছেন ছবিগুলো তাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে। একা হলেও নিজের সঙ্গে ঝগড়ায় রত, নিজেকেই ধাক্কা দিচ্ছেন। এবং কাগজের উপর জিনিসগুলোর পুনর্জন্ম হচ্ছে, স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিকের থেকেও বেশি, সুন্দর এবং সুন্দরের থেকেও অতিরিক্ত কিছু, মৌলিক এবং উৎসাহী যাপনে পরিপূর্ণ তার স্রষ্টার আত্মার মতো, প্রকৃতির থেকে চোলাই করা এক ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়া। যে সমস্ত কাঁচামালে স্মৃতি ভারাক্রান্ত সে সবকে বিন্যস্ত করে, শ্রেণীবদ্ধ ও সুসংহত করে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া যা আবার শিশুসুলভ উপলব্ধির ফল সে উপলব্ধি তীব্র ও জাদুকরি তার সারল্যের জন্য!

....................................


অনুবাদকের পরিচয়

শুভ মৈত্র 'কলকাতা শহরের'এমনটা বললে অত্যুক্তি হয় না। জন্ম এই শহরেই ১৯৮০তে। পড়াশোনা, সাংবাদিকতা, লেখালিখি, প্রেমসবই তার বলা যায় এই শহরের চৌহদ্দিতে। আর কে না জানে এ কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষের শুধু নয়, আসলে এই পৃথিবীরই একটি শহর। শুভ মৈত্র তার সাংবাদিক তকমাটি অবিশ্যি খুব বেশি দিন নিজের সঙ্গে রাখেননি। তিরিশের মধ্যেই প্রাক্তন হয়ে এখন যাকে বলে পূর্ণ সময়ের লেখক। লেখক তো বটে; কিন্তু কোন জনরাতে তার বসবাস? তিনি কি কবি? গল্পকার? ঔপন্যাসিক? প্রবন্ধকার? নাকি অনুবাদক? 



তার বইপত্তর :-

কবিতার বই

জাদুকরি বইঘর (২০১৪)

আদার ব্যাপারী যাবে আর্মেণী ঘাটে (২০১৬)

ছোট গল্প সংকলন

জেরি ইঁদুরের গর্ত থেকে (২০১৮)

উপন্যাস

গুলজার শহরের পক্ষী ও নাগর (২০২০) 

            

Comments

Popular posts from this blog

সরসিজ বসুর সাক্ষাৎকার। স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত

তদোগেন গিরতের 'যে কথা মরমে বাজার নয়'

প্রশান্ত হালদারের কবিতা—জন্মদিনে মদ খাও বন্ধুরা