সরসিজ বসুর সাক্ষাৎকার। স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ছবিটা এখন আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নেই, সিপিয়া কালার হয়ে গেছে
ক থো প ক থ নে সরসিজ বসু
![]() |
কবিতা
ও গদ্য লিখনে তাঁর সমান গতায়াত। তিনি লেখার সঙ্গে নিজের পাঠক সত্তাটিকেও সযত্নে লালন করে চলেন । কিন্তু এখানে আমাদের
কথাবার্তার বিষয় হল তাঁর সম্পাদনা । গত পাঁচ বছর ধরে (২০১১-১৬) তিনি খুব কৃতিত্বের
সঙ্গে সম্পাদনা করে চলেছেন ‘বকলম’ পত্রিকাটি । তিনি সরসিজ বসু । বকলম পত্রিকা ও
সম্পাদনার খুঁটিনাটি জানার উদ্দেশ্য নিয়ে এই কথোপকথন শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত সময়, সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যের
বিভিন্ন পরিসরকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে, বাকিটা পাঠক বুঝবেন !
সূত্রধরের ভূমিকা পালন করলেন তরুণ প্রজন্মের কবি স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত । সম্পূর্ণ
সাক্ষাৎকারটি দূরভাষ যন্ত্রে গৃহীত ।
কবিতা ও গদ্য লিখনে তাঁর সমান গতায়াত। তিনি লেখার সঙ্গে নিজের পাঠক সত্তাটিকেও সযত্নে লালন করে চলেন । কিন্তু এখানে আমাদের কথাবার্তার বিষয় হল তাঁর সম্পাদনা । গত পাঁচ বছর ধরে (২০১১-১৬) তিনি খুব কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পাদনা করে চলেছেন ‘বকলম’ পত্রিকাটি । তিনি সরসিজ বসু । বকলম পত্রিকা ও সম্পাদনার খুঁটিনাটি জানার উদ্দেশ্য নিয়ে এই কথোপকথন শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত সময়, সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যের বিভিন্ন পরিসরকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে, বাকিটা পাঠক বুঝবেন ! সূত্রধরের ভূমিকা পালন করলেন তরুণ প্রজন্মের কবি স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত । সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি দূরভাষ যন্ত্রে গৃহীত ।
স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত : কেউ আমাকে বলেছিলেন আপনার বাবার নাম বুদ্ধদেব বসু ...
সরসিজ বসু : ভালো বলেছেন ! নিন,
এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করুন ।
স্বর্ণেন্দু : আসলে সেই রসিক লোকটি —আমি রসিকই বলব তাকে—কে, আমার মনে পড়ছে না ! ২০১১-১২ বকলমের
প্রথম দুটো সংখ্যাই বোদলেয়ার নিয়ে । তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন,
বুদ্ধদেবের ফেলে যাওয়া কাজ আপনি সম্পূর্ণ করছেন । অবশ্য বুদ্ধদেব বসু কোনোদিন
বোদল্যার বলে লেখেন নি, সুতরাং উচ্চারণও করেননি ধরে নেওয়া যায় ...
স্বর্ণেন্দু : বাংলায় পত্রিকার অভাব নেই, তারপরেও কিছু একটা অভাব নিশ্চয় ছিল, যার জন্য বকলম...
সরসিজ : বাংলায় পত্র-পত্রিকা ঢের আছে, কিন্তু সাবালক পত্রিকার সংখ্যা হাতে গোনা
। সুধীন্দ্রনাথের পরিচয়, শিবনারায়ণের
জিজ্ঞাসা বা প্রথম যুগের চতুরঙ্গ, এরকম সারস্বতচর্চার স্তরের কাগজ কি আর হবে ?
বকলম দিয়ে একটা চেষ্টা আমরা শুরু করেছি, দেখা যাক — ।
আমরা এখন একেবারে প্রথম পর্যায়ের কাজই করছি ।
জানাবোঝার কাজ । পাশাপাশি আরও দু-একটি পত্রিকার কথা বলা যায় ...
স্বর্ণেন্দু : একটি পত্রিকার সাবালক হয়ে ওঠার পেছনে কী কী গুণ থাকা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
সরসিজ : সাবালক হবার ইচ্ছেটা থাকা চাই । অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ । তার ওপর পত্রিকাটা
কতটা অতীত আর পরিপার্শ্ব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে তার সঙ্গে মেশাতে পারে পত্রিকাগত
মূল্যায়ন সেটাই আসল কথা, সেখানে রচনা নির্বাচন করাও একটা বড় ব্যাপার । এ ব্যাপারে
সমকালীন জগতের চিন্তাধারার সঙ্গেও পরিচয় থাকা জরুরি । এখন
যেমন বকলমই হয়ে উঠেছে আমাদের অভিভাবক, কারণ একটানা পাঁচ বছর কাজ করতে করতে আমরাও
অনেকটা স্বাবলম্বী করে তুলতে পেরেছি নিজেদের ভাবনাচিন্তা ।
আমার নিজের জীবনেও বকলম একটা সিগনিফিকেন্ট অবস্থান ।
স্বর্ণেন্দু : বিভিন্ন দেশে ঘোরার
অভিজ্ঞতা আছে আপনার । সেসব
দেশের লিট্ল ম্যাগাজিনগুলোর সংস্পর্শে আসার সুযোগ কখনো হয়েছিল ?
সরসিজ : না, একেবারেই সুযোগ হয়নি । বিদেশবাসের বছরগুলোই, এখন মনে হয়, আমার সবচে’
খারাপ জীবন । বই-পত্র বা
পত্রিকা থেকে শতহস্ত দূরে দূরে থাকাই পছন্দ করতুম ।
স্বর্ণেন্দু : বইমেলায় বকলমের টেবিলে দেখেছিলাম একা বসে আছেন । কোনো ভিড় নেই, ক্যামেরা নেই, তাহলে ...
সরসিজ : কলকাতা বইমেলা একটা হাট । শুধু বকলমের পাঠকদের টানেই, ২০১১ থেকে এই
পাঁচবছর পত্রিকার টেবিলে বসছি । অল্প হলেও বকলম-এর এখন ১০০-১৫০ জন নিয়মিত পাঠক
আছেন। আর একা একা বসে থাকলে, টেবিলে ভিড় না বাড়ালে, অনেক বাজে সংস্রব এড়ানো যায় ।
যে প্রচার আমাদের পত্রিকার কোনো কাজেই লাগবে না তার জন্যে অপেক্ষা করি না,
আন্দোলনও করি না ।
স্বর্ণেন্দু : নিছক প্রচারিত হওয়ার নির্লজ্জ
তাগিদে নয়, বৃহত্তর পাঠকের অবগতির জন্যেই যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রচার জরুরি
বলেই মনে হয় । শুধু বকলমের পাঠকদের কথা ভেবে , ৪-৫ ঘন্টা টেবিলে বসে থাকলেই কি সব
উদ্দেশ্য সফলতা পাবে ?
সরসিজ : বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছবার কথা ভেবে এখনো পর্যন্ত আমরা কিছু করিনি । আগে
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মননশীল বেইমানীগুলো চিনে নিই, তারপরে আরও বড় কিছু নিয়ে ভাবার
সময় আসবে ...
স্বর্ণেন্দু : আপনাদের পত্রিকার
বিষয়সূচি কি আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়, না লেখক/অনুবাদকেরা যে লেখা /
অনুবাদ দেন, অবশ্যই পত্রিকার মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, সেগুলি-ই গ্রন্থিত করা
হয় ?
সরসিজ : হালকা
মদ্যপানের টেবিলে কথাবার্তা
হয় চারবন্ধুর মধ্যে, একটা খোলামেলা খসড়া প্রস্তাব ওঠে,তারপর অদলবদল বা নতুন সংযোজন
মোটামুটি আমাকেই করতে হয় । লেখা পছন্দ না
হলে চেয়ে নেওয়া লেখাও আমি বাদ দিই, কিছু করার থাকে না ।
কোনো কোনো লেখায় বিস্তর সম্পাদনা করতে হয়, বিশেষ করে অনুবাদের ক্ষেত্রে । তাতে কেউ
কেউ রাগ করেন... কী করব ... একজন তো কথা বলাও বন্ধ করেছেন, যাক গে । বলুন —
স্বর্ণেন্দু : বকলম শুরু করার আগে
...
সরসিজ : বকলম শুরুর আগের ঘটনা হল, আমাদের এক অসাধারণ বন্ধু ছিলেন, অকাল প্রয়াত
দিলীপ ঘোষ , আমরা তাঁরই পত্রিকা-বন্ধু ছিলুম ।
তবে একটা আইডিয়া ছিল নতুন কাগজ করার , যেখানে সাহিত্যের পাশে রাজনীতির প্রসঙ্গ ও
পরিসর থাকবে, তত্ত্বচিন্তা থাকবে, ইত্যাদি । বিশ্বনাথ কৌশিক সুমন্ত আর আমি একসময়
স্থির করে ফেলি, কাগজটা করতে হবে । বিশ্বনাথই ছিল অগ্রদূত ; বোদল্যার নিয়ে
আইডিয়াটা ওরই, আর বকলম নামটা দেয় কৌশিক, খুব আচমকা । তারপর আর কাজ থেমে থাকেনি...
স্বর্ণেন্দু : বন্ধুদের কথা বারবার উঠে আসছে, তাঁদের নিয়ে একটু বিশদে বলুন ...
সরসিজ : বকলম পত্রিকাটা তো বিশ্বনাথের আত্মা । আইডিয়া থেকে শুরু করে ভালমন্দ সবই
ওর স্বপ্নে জাগরণে লেপ্টে আছে । কৌশিক আর সুমন্ত কর্মসূত্রে ওরই সহযাত্রী এবং
দারুণ মেধাবী । বকলম-এর যে
ধারাবাহিকতা তা এই তিনের অনবদ্য উৎসাহ এবং মেধার ফল । এই বন্ধুরাই আমাকে সম্পাদক
করেছে, আমার কাজটা অনেকটা কাজ আদায়ের কাজ, পাঠভেদের কাজ । তবে
পত্রিকার বাইরেও দুজনের নাম করতেই হবে যাঁরা আমাদের আপনজন হয়ে গেছেন । একজন শ্রী সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আর
একজন শ্রী প্রবাল দাশগুপ্ত । তরুণ কবি প্রশান্ত হালদারও বকলমের একজন শ্রমিক । আর
জয়শ্রী প্রেসের শ্রীকান্ত বসাকের মতো মানুষকে পাশে পাওয়াটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার ।
স্বর্ণেন্দু : বকলম কি বাঙালি
পাঠক-তত্ত্বজিজ্ঞাসুদের কাছে নতুন কাউকে পরিচিত করতে পেরেছে, এর আগে আমাদের কাছে
যিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন ?
সরসিজ : আমরা সেরকম কিছু ভেবে তো করছি না ।
আমরা যেটা করছি, এক-একজন তাত্ত্বিক কিংবা মনীষীর ‘সময়ানুগ’ ভাবনার কিছু কিছু
প্রতিফলন ঘটাচ্ছি অনুবাদের মাধ্যমে এবং আমাদের সাধ্য অনুযায়ী । তাতে যদি কেউ উৎসাহ
বোধ করেন তিনি আরও বিস্তৃত খোঁজখবর করতে পারেন । এই
ধারণা থেকে বাংলা অনুবাদে আমরা এমন কয়েকজনের গল্প প্রবন্ধ কবিতা তত্ত্বচিন্তা
ছেপেছি যাঁরা সম্ভবত বকলমের পাতাতেই প্রথম অনূদিত হলেন । আপনি শুনতে চাইছেন বলেই
বলছি, এঁদের মধ্যে আছেন লিউ শিয়াও পো, মরিস ব্লাঁশো, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, স্লাভয়
জিজেক,কার্ল ক্রাউস, ফের্নান্দো পেসোয়া, পেরি রোসি, ম্লাদেন দোলার, হানা আরেন্ড,
অদ্রি লর্ড, হ্বিটগেনস্টাইন । ফুকো, বেঞ্জামিন, লিওতার, ভালেরি,
পেনরোজ, পপার-এর লেখাও এর আগে বোধহয় অনুবাদ হয়নি বাংলায় ।
স্বর্ণেন্দু : বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য দুটোর কোনোটাই খুব স্বস্তিদায়ক জায়গায় নেই বোধহয় আপনার/আপনাদের চোখে । বকলমের বেশিরভাগ জুড়ে বিদেশী সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্বের অনুবাদ, বাংলা ভাষায় রচিত মৌলিক সাহিত্যের স্থান সে তুলনায় খুবই অল্প । এর পেছনের যুক্তি বা ক্ষোভ জানতে চাইছি ।
সরসিজ : এখানে ক্ষোভের কথা আসছে কেন ? যুক্তিই বা হুটহাট করে কেন টানব ? আমরা শুরু
থেকে খুব বেশি করে বিভিন্ন সাহিত্যচিন্তা, সমাজচিন্তা ইত্যাদি অনুবাদ করে এই
শিক্ষাটার গতিপ্রকৃতি বুঝতে চেয়েছি যে পশ্চিমে তারা কী করে এতদূর সমৃদ্ধ হল ?
কতখানি পরিশ্রম আর অনুশীলন রয়েছে তার পেছনে ? সেটা যখন একরকম পরিষ্কার হয়ে যেতে
থাকল, যে হ্যাঁ, তারা নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা-র ভেতর দিয়ে, বিভিন্ন আন্দোলনের
ভেতর দিয়ে, উৎপাদন, বিলিবন্টন ব্যবস্থা আর শিক্ষাসংস্কারের ভেতর দিয়ে,
বিজ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়েই এতদূর এগিয়েছে, তখন আমরা বকলম-এ অনুবাদ করতে থাকলাম
সেইসব ‘সাড়া জাগানো প্রবন্ধমালা’ যা তাদের অনুপ্রাণিত করেছে—
কখনও বিকল্পের দিকে যেতে, কখনও বিস্তারের দিকে যেতে । এটা ঠিক, এইরকম ধারাবাহিকভাবে
বাংলাভাষায় বকলমের আগে এই কাজ সম্ভবত হয়নি । এতে তো বাংলা ভাষা তথা আমাদের নিজেদেরই
লাভ হল— হল না কি ? আর এটা যখন ঠিক এইভাবে আমরা উপলব্ধি করতে
পেরেছি, তখনই ষষ্ঠ সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪ থেকে আমরা ‘দৃষ্টি সৃষ্টি উদ্ভাবনা’ নামে
বাংলায় সৃষ্টিশীল লেখা ছাপার জন্য একটা পরিসর তৈরি করি, যেখানে গল্প, কবিতা, গদ্য,
আলোকচিত্র এমনকী ছোট নভেলও ছাপা হয়ে চলেছে । আর ‘অন্যান্য লেখা’ বিভাগটা তো
একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকেই আছে । সেখানে বাংলা কবিতা ছাপা হয়েছে, নিবন্ধ ছাপা
হয়েছে, ছোট ছোট গদ্য ছাপা হয়েছে । পত্রিকাটা একটু খুঁটিয়ে দেখবেন, সবই নজরে পড়বে
ভাই ! আমাকে খুবই পরিশ্রম করতে হয় এই কাগজটার সমস্ত খুঁটিনাটি সম্পাদনা করতে,
এর চরিত্রটা কেউ ধরতে না পারলে একটু খারাপ
তো লাগেই ।
স্বর্ণেন্দু : এ বিষয়টি স্পষ্ট যে,
আমাদের উত্তর আধুনিকতা এবং ওদের পোস্টমডার্নিটি এক জিনিস নয়, যেমন রেনেসাঁ নবজাগরণ,
আধুনিকতা মডার্নিটি,এ সবের মধ্যেই এক অসেতুসম্ভব দূরত্ব থেকে গেছে । বিদেশী
সাহিত্যতত্ত্ব যেহেতু আপনাদের ভাবনার অন্যতম বিষয়,এখন আমার জিজ্ঞাস্য হলো, এ হেন
অবস্থায়, প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমাদের , বাঙালির, সাহিত্য ব্যাখ্যা করতে
যাওয়া কতখানি যুক্তিসঙ্গত ?
সরসিজ : দেখুন, এই প্রশ্নটার উত্তরে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই । আপনি এই যে
স্বদেশী সাহিত্য বিদেশী সাহিত্য বলে আলাদা আলাদা জিনিস দেখছেন, সে আপনি দেখতেই
পারেন, কিন্তু এর মধ্যে একধরনের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা আছে, সেই শিক্ষাটা আপনাকে
ইতিহাস দিয়েছে, সাহিত্য দেয়নি । অর্থাৎ আপনি ইতিহাসের চোখ দিয়ে সাহিত্যকে দেখছেন ।
আর সেটা পরিষ্কারভাবে রাজনৈতিক কিংবা স্বাভিমানী ভাবালুতার ফল—একদম পচা জিনিস, জ্ঞান বোধ বিস্তৃতির শত্রু বলতে পারি, মেধার অপুষ্টি !
আরে বাংলা তো আমার একটাই ভাষা, আর সারা দুনিয়ায় যে একশোটা ভাষা ছড়িয়ে আছে, নিরন্তর
পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল বেরোচ্ছে, আমাদের সজাগ থাকতে হবে না ? বাংলায় যত পত্রিকা আর
লিট্ল ম্যাগাজিন সব তো স্বদেশীয়ানাতেই ভরপুর, তাই না ? কিন্তু এই ইন্টারনেটের
যুগে আপনি স্বদেশীয়ানা কোথায় পাচ্ছেন বলুন তো ? স্বদেশীপনা হয়ত দেখছেন । বকলম এই
নড়বড়ে চৌকাঠটা পার হয়ে গেছে । এবার
আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি ।
প্রথম কথা, রেনেসাঁ আর নবজাগরণের পার্থক্য যদি
থাকে, সেটা আপনি বুঝতে পেরেছেন, তাহলে বলুন— রেনেসাঁ কাকে বলে ?
রেনেসাঁর পথিকৃৎ কেউ ছিলেন কি ? এই রেনেসাঁ কি কোনো ডায়ালেক্টিক্যাল প্রগতির ফসল ?
মুশকিল কি জানেন, এইসব প্রশ্ন বা অনুভূতিগুলোই বড্ড তার-কাটা, প্রশ্ন করা মাত্রই
প্রশ্নকর্তার দায় শেষ হয়ে যায় । আপনাকে বলছি— যারা এই জাতীয়
কথা বলে, যেমন অমুক উপন্যাসে পাঠকের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দেওয়া হল ? তমুক সিনেমায়
কেন স্বদেশী ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা করা হল ?— এইরকম আর কী,
আমার তো মনে হয় শিল্প-সাহিত্য শব্দটা ছুঁয়ে আছে বলেই এসব অদ্ভুত প্রশ্ন ওঠে । এসব
প্রশ্নে একধরনের রেডি-মেড বাস্তবতার সেবাদাসত্ব থাকে যাতে পাঠকমনের অন্ধকারে
সুগন্ধী ফেলে দেওয়া যায় । পাঠক জানতেই পারবে না, লেখক তার সঙ্গে আগাগোড়া পাঠকবাজি
করে যাচ্ছে, যেন লেখক লোকটা কত ভালো, কত জানে, কী মহৎ তার ভাবনা ! এবারে আমরা
জানতে চাইছি সে চতুর অভিনেতা কিনা । সে
কোন্ ক্ষমতার প্রতিবেশী, সে কোন্ দলের হয়ে ওকালতি করে ? তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে
জেনে নেওয়া দরকার, সে কতবড় আগাছা, প্রতিষ্ঠানে পরগাছা হয়ে আছে ! এইবার বলি, রেনেসাঁ
আর বাংলার নবজাগরণ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, তার কারণ ইতিহাসের পটভূমিটাই
ভিন্ন । এসব নামকরণ আমরাই করেছি স্বাভিমানের আহ্লাদে । আর এটা মনে রাখা দরকার,
আধুনিকতার ইতিহাস পশ্চিমেরই সৃষ্টি, আমরা তাতে জোড়াতালি দিয়ে সামিল হয়েছি মাত্র ।
এই জন্যেই দূরত্বটা এত চোখে লাগে ।
আপনার এই প্রশ্নের আরো একটি ভাগ আছে, ওদের
সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমাদের সাহিত্য ব্যাখ্যা করতে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কিনা ! প্রথম কথা, পশ্চিমী সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমাদের
সাহিত্যের ব্যাখ্যা সচরাচর দেখা যায় না, অত বড়মাপের তাত্ত্বিক এখানে সমালোচকদের
মধ্যে নেই । দ্বিতীয় কথা, যেটা দেখা যায়, পশ্চিমী
ধ্যানধারণা আর শিল্পকুশলতার অনুসরণ ও অনুকরণ । এই দ্বিতীয়টা সাধারণভাবে আধুনিক
ঔপনিবেশিক সভ্যতার ফল, আধখাওয়া ফল, বাংলা গদ্য ভাষা আর সংবাদপত্রের জন্মই তো
ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে । আপনি যে দূরত্বের কথা বলছেন, সেটা দূরত্ব নয় ভাই,
বিপথগামিতা । তার মানে এই নয়, পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমরা সাহিত্যবিচার করব
না । নিশ্চয়ই করব । তত্ত্বটা তো আবিষ্কৃত একটা পদার্থ । আমি বলতে চাইছি তাদের
আবিষ্কৃত পদার্থগুলো না নিয়ে আমাদের উপায় নেই । এটাই তো সভ্যতার ধারা । এখানে
হিংসে করারও কিছু নেই, বিরোধ-বিভাজনেরও প্রয়োজন নেই । বরং স্বাভিমান আর
কূপমণ্ডূকতা যে একই জিনিস এটা বোঝা দরকার । দেশরক্ষার জন্যে রাজনৈতিক স্বাভিমান
দরকার হতে পারে, সাহিত্য-শিল্পের জন্যে দরকার মুক্তদৃষ্টি ।
কোনো দেশের সাহিত্য মানে সেই দেশের অন্তর্লোক, যা সেই দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক
গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে বহুদূর বিস্তৃত । নইলে আমরা বিদেশী সাহিত্য পড়ি কেন ? বিদেশীরাই
বা পথের পাঁচালি কেন দেখে ? মার্গ সংগীত কদর পায় কী করে ?
স্বর্ণেন্দু : বাঙালি তাত্ত্বিকেরা এ
বিষয়ে কতটা সচেষ্ট, বাঙালির নিজস্ব
সাহিত্যতত্ত্ব নির্মাণে তাঁদের অবদান নিয়ে বলুন, আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ...
সরসিজ : তত্ত্ব নিয়ে কেউ বড় একটা মাথা ঘামাতে চায় না ।
বাঙালিরা স্বাভাবিকভাবে মামুলিয়ানা একটু বেশী পছন্দ করে, সহজিয়া রগড় পেলেই খুশি
হয়, যেমন বাঙালির শহর হল গ্রামজীবনেরই এক্সটেনশন । আর তত্ত্ব নিয়ে এক আধজন যাওবা
ভাবনাচিন্তা করছেন, সেসব চোঁয়ানো জিনিস, খানিক চোলাই, খানিক চাতুরি । এদেশে তত্ত্বচিন্তা দূরে থাক, সাহিত্য
নিয়েই এখন যে অন্তঃসারশূন্য খেলা চলছে, সেটাকে আমি বলি বুকে-টেনে-নেওয়ার-বেইমানী ।
স্বর্ণেন্দু : আপনার আগের তিনটি উত্তরের নিরিখেই বলি, পশ্চিমের সমাজ যেগুলি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, আন্দোলন, শিক্ষাসংস্কারের মধ্য দিয়ে অর্জন করল, সেগুলো-কে শুধুমাত্র অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষায় নিয়ে আসা যদিও বা যায়, আমাদের মনন বা অভিজ্ঞতার অংশ করে নেওয়া বোধহয় যায় না । সুতরাং ফাঁক একটা থেকেই যাচ্ছে । আপনি কি এই ভাবনাটিকেও ‘রেডি-মেড বাস্তবতার সেবা-দাসত্ব’ বলবেন ?
সরসিজ : আচ্ছা এই যে প্রশ্নটা আপনি করলেন এটায় আপনি আগের আগের প্রশ্নটাই আরেকটু
স্ফীত করলেন । আগের আগের প্রশ্নটায় বলেছিলেন, পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে আমাদের
সাহিত্যের ব্যাখ্যা করতে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত কিনা ! আমি তাতে বলেছিলুম— শুধু যুক্তিসঙ্গত কেন, এটাই সভ্যতার ধারা । আর
এখন বলছেন, পশ্চিমের অনুশীলন পরিশীলনগুলো আমাদের মনন বা অভিজ্ঞতার অংশ হতে পারে
কিনা, ফাঁক থেকে যেতে পারে । দেখুন, এই বিশ্বায়নের জগতে সমস্ত মূল্যবান
পার্থক্যেরই মরণ হয়েছে — আমি নিজেই কোনো একটা লেখায় লিখেছিলুম । এখন
আমরা একটা পৃথিবীজোড়া সাদৃশ্যের ভাগাড়ে
পড়ে আছি, এরকমও লিখেছি । যাইহোক, আপনি
তো আর মৃত পার্থক্যগুলো ফিরিয়ে আনতে পারেন না, তাহলে স্বদেশ-বিদেশ করে করে কতক্ষণ
আর আপনি আপনার ভবিষ্যৎকে পিঠ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবেন ? কারণ, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোর
স্বদেশ-বিদেশ পার্থক্য হয় না । এটাই
বিশ্ব-পরিস্থিতি, এটাই বিশ্ব-বাজার—ছাত্ররা, পেশাবাজরা
সারা দুনিয়া চষে ফেলছে । আবার
যেখানে স্বদেশ-বিদেশ পুব-পশ্চিম হয়, সেখানে আসবে তুলনামূলক আলোচনার প্রসঙ্গ, যেমন
তুলনামূলক সাহিত্য পড়ানো হয়, সমাজনীতির তত্ত্ব পড়ানো হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
ইতিহাস পড়ানো হয়— কারণ সব কিছুর স্ট্যাণ্ডার্ড স্থির হয় মীমাংসার সুবিধের জন্য । অর্থাৎ
তাত্ত্বিক মননের পুব-পশ্চিম হয় না, কিন্তু ভাষার হতে পারে, আচরণবিধির হতে পারে,
অভ্যাসের হতে পারে । আপনি যে ফাঁক থেকে যাওয়ার কথা বলছেন এটা আসলে একধরনের বদ্ধ
অভ্যাসজনিত ভীতি, যে ভীতি থেকে জন্ম নেয় আঞ্চলিক থেকে যাওয়ার গোঁড়ামি যা ভবিষ্যৎকে
পথে বসায়, নয়তো বিলম্বিত করে । তবে শুধু কয়েকটা অভ্যেসের বশে যেমন
দেশজ্ঞান/দেশপ্রেম হয় না, তেমনি কয়েক টুকরো অনুবাদ দিয়ে সিদ্ধিলাভ করা যায় না ।
বকলমে আমরা সেই চেষ্টা করছিই না । আসল কথা ফুটবলে ইয়োরোপকে হারাতে গেলে তাদের চেয়ে
ভালো খেলেই হারাতে হবে, ইন্ডিয়ান স্টাইলে ফুটবল খেলে সেটা এখন হবে না । যেমন হয় না দাবায়, যেমন হয় না অ্যাথলেটিক্সে । সাহিত্যে তাদের চেয়েও উন্নত
হতে হলে তাদের চেয়েও শক্তিশালী ভাবনা আমাদেরই ভাবতে হবে । নকল করলে হবে না ।
নিজেদের নৈতিক জীবন ও ঐতিহ্যকে আরওস্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করতে হবে আমাদের । শুধু
প্রশ্ন তুললে, অতীতকে কাঠগড়ায় তুললে হয় না । নতুন করে ভাবতেও হয়, আবিষ্কারের
ঝুঁকিও নিতে হয় । শুধু মনীষীদের ম্যাসকট বানিয়ে পালাপার্বণ করে গেলে হবে ? এরই বরং
নাম দিন প্রাচ্যত্ব যেখানে মনীষীরা ম্যাসকট হয়েছে, ঐতিহ্য হয়েছে বিক্রির জিনিস আর
জনসাধারণ মজেছে অসহ্য আত্মরতিতে । আপনার
প্রশ্নটাকে এবার যদি একটু ঘুরিয়ে দেখি, আপনার মূল আপত্তিটা সম্ভবত পশ্চিমের ইচ্ছা
বা চোখ দিয়ে আমরা যেন আমাদের প্রাচীন ধর্ম বা ইতিহাসকে ব্যাখ্যা না করি, এমনকী
আমাদের সমাজ-সংস্কারের বাঁধনটাকেও আমরা উপেক্ষা না করি, তাহলে বলব এ-তো একটা
বহুচর্চিত বিষয়, বড় বড় কাজ হচ্ছে এ নিয়ে, সাইদের ওরিয়েন্টালিজম-ই দেখুন না ! আবার
ভারতবর্ষ নিয়ে মূল্যবান কাজ করতে গিয়ে এরকম ভুল পশ্চিমের মনীষীরা পর্যন্ত করেছেন,
সেই ম্যাক্সমুলারে বোধহয় এর শুরু । কিন্তু এখন একটা নতুন ট্রেন্ড আসছে । পশ্চিম
এখন আধুনিকতার সূর্যাস্ত দেখে ফেলেছে । তারা এবার পুবমুখী হবার কথা ভাবছে । এ তো
কবে মহাকবি গ্যেটে লিখে গেছেন, পুবের বাতাসটা ছিল বলে রক্ষে । অথচ আজকে আমরা আর
কতটুকু ‘পুব’ আছি ? থাকার মধ্যে দেশে আছে একটা বিরাট বাজার, সেটা নিয়েই কাড়াকাড়ি ।
এদিকে আমরা ইণ্ডিয়ার অধিবাসীরা আর কতদিন ভারতের জয়গান গাইব ? গ্রীস, ইরাক, চীন কি
এইরকম করে ?আমরা দেশের বৈচিত্র্যের কথা বলি অথচ অন্তর থেকে বৈচিত্র্যকে সেলিব্রেট
করি না । আমাদের অস্তিত্ব এখন ইণ্ডিয়ার, ভারত হল ইতিহাস, সেখান থেকে কিছু কিছু রসদ
আমরা পেতে পারি বটে, কিন্তু ইণ্ডিয়া থেকে ভারতে আর ফিরতে পারি না ।
ব্রাহ্মণ্যবাদের মতো কোনো আধিপত্যবাদী সিস্টেমের ফাঁদে আর পা দিতে পারি না । তার
চেয়ে বরং এখনকার আগ্রাসী বাজারনীতি মোকাবিলা করার উপায় খুঁজতে পারি । তাও যদি
ভারতবর্ষের প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আনুগত্য থাকে, পিতৃপুরুষের জন্য কিছুমাত্র
দরদ থাকে, তাহলে ইণ্ডিয়ায় থেকেই সেই আনুগত্যের যোগ্যতা আমাদের অর্জন করতে হবে ।
হচ্ছে কি তা ? গবেষণাটা কোথায় হচ্ছে ? শুধু অভিমান আর হামবড়াই দিয়ে হবে ? বরং
যোগ্যতাহীন আনুগত্যেররাজনীতিই হবে । প্রতিষ্ঠান ফুলে ফেঁপে উঠবে, ছোট-বড় থীম পুজোও
চলতে থাকবে—ব্যাস, খতম...খতম...
স্বর্ণেন্দু : বিশ্বায়ন আপনার কাছে সব পার্থক্যের অবসান হতে পারে, কিন্তু আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ১৯৭৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক হেনরি কিসিঞ্জার বিশ্বায়ন-কে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘অ্যামেরিকান ডমিনেশন অফ্ দ্য ওয়ার্লড’ বলে । আসলে এখানেও সেই আধিপত্যবাদের গল্প, যে সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আফ্রিকার লেখক, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ-কে একদিন নিজের ভাষা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সংরক্ষণের জন্য, ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’-এর কথা ভাবতে হয়েছিল...
সরসিজ : দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার কথা থেকে আমার একটা প্রশ্ন মনে পড়ে যাচ্ছে ।
প্রশ্নটা হল, বিশ্বায়নের মধ্যে কি বৈষম্যের বিশ্বায়নও দেখছি না আমরা ? বিশ্বায়ন তো
আকাশ থেকে পড়েনি ভাই! দর্শন, বিজ্ঞান তো চিরকাল বিশ্বায়নের দিকেই গেছে, আমরা তখন
অন্য নামে চিনতুম, এখন এসে জুটেছে রাজনীতি তথা বাজারনীতি— আর
এটাই হবার ছিল । তবে তার পুরোটা শত্রুরা কবজা করে রেখেছে এটা ভাবা মানে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করা । চমস্কি তো নিজেই লিখেছেন, বিশ্বায়ন চলেছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বা
লোকাল অটোনমির দিকে । এদিকে আমরা যে আদিবাসীদের টোপ দিয়ে ঢপের মেইন স্ট্রিমে টেনে
আনছি, সমাজে কায়স্থ বাড়াচ্ছি—এটা ভালো না খারাপ ? আর
বিশ্বায়নের তত্ত্ব মাত্রই খারাপ, বিশ্বায়নে আমেরিকার আধিপত্যই শুধু দেখা যাচ্ছে,
বিশ্বায়নের রাজনীতি সমস্ত ভাষাসাহিত্যসংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক, এতটা ভয়ের
অভিজ্ঞতা হেনরি’র হয়ে থাকতে পারে কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে, পৃথিবীর যেমন
একটা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আছে, তেমনই সমস্ত ভাষাসাহিত্যসংস্কৃতিরও অনন্য অস্তিত্ব
সুরক্ষিত থাকার প্রয়োজন । আমি আগের প্রশ্নে যে গোঁড়ামির কথা বলেছি তার সঙ্গে এটা
যেন গুলিয়ে ফেলবেন না । তবে আমি এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না, শুধু এইটুকুই বলব
পুঁজির চরিত্র বদলে গেছে বিশ্বায়নের জগতে । বৃহৎ
শিল্পের যুগে পুঁজির চরিত্র যে হায়ারার্কির ওপর নির্ভর করত, সেই ক্ষমতায়নের
পিরামিড এখন ভেঙে পড়েছে । হায়ারার্কির জায়গা নিয়েছে পুঁজির (অ)সংঘটিত বা মুক্ত
অঞ্চলবিশ্ব, যাকে আবার বলা হচ্ছে (G)localization বা
গ্লোকালাইজেশন, কেউবা বলছেন লেট্ ক্যাপিটালিজম । এ নিয়ে একটা সুলভ বইয়ের কথা বলতে
পারি, তাতে বিশ্বায়নপ্রসঙ্গে আপনাদের আগ্রহের ছবিটা আরো স্পষ্ট করে নিতে পারবেন ।
জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ইংরিজির অধ্যাপক সৌগত ভাদুড়ির সম্পাদনায়, দিল্লির
অ্যানথেম প্রেস থেকে একটা সঙ্কলন বেরিয়েছে ২০০৮ সালে, বইটার নাম Negotiating Glocalization । বইটার
বেশিরভাগ লেখকই ভারতীয় । আর একটা অনবদ্য বই ছেপেছে দিল্লির ওয়ার্ল্ডভিউ, The World of
the Third and Global Capitalism ।
স্বর্ণেন্দু : একটু আগে আপনি বলছিলেন, এখন আমাদের ঐতিহ্য হয়েছে বিক্রির জিনিস আর জনসাধারণ মজেছে অসহ্য আত্মরতিতে—এটা আপনার পর্যবেক্ষণ । কথাটি একটু বিশদে বললে, বিশেষ করে ঐতিহ্য সম্বন্ধে, ভালো হয় ।
সরসিজ : দেখুন এই মুহূর্তে ঐতিহ্য নিয়ে কিছু বলাটা খুব বিস্বাদের ব্যাপার । এটা
নিশ্চয় বুঝবেন, মাত্রাছাড়া অপব্যয়ের জন্যই ঈশ্বর ধর্ম আর ঐতিহ্য কথাগুলো অনেক সময়ই
এখন বিরক্তিকর লাগে । লক্ষ করে দেখবেন, ঐতিহ্য কথাটা সাধারণত ওঠে যখন বেকায়দা কোনো
পরিস্থিতির মুখোমুখি বা বিপরীতে কিছু একটা খাড়া করাবার দরকার হয় ।এই সর্বাত্মক
ব্যবসার যুগে, পিতৃমাতৃহীন সমাজে, টাকাকড়ি-সর্বস্ব সম্পর্কের জগতে শব্দ বা আখ্যার
গুরুত্ব কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে গেছে । ঐতিহ্য
কথাটাকেও বিপথগামী অধিবিদ্যার বিষয় করে ফেলা হচ্ছে । যেমন আমাদের জাতীয়তার
ঐতিহ্যের বেলায় হয়েছে, প্রতিবেশী একটা রাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে খাড়া করে,
মাঝে মাঝে আমাদের জাতীয়তার ঐতিহ্য জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, সেটা হল ঘৃণা দিয়ে তৈরি
দেশপ্রেম । এদিকে দেশের মধ্যে দেশপ্রেমিকের সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিজের দেশেই ডুবতে থাকা মানুষের দল, আত্মহত্যা । এই অসহ্য তামাশায় লাভবান হচ্ছে কে ?
আচ্ছা,এবার মনে করুন, মহিলাদের শাঁখা সিঁদুরের ব্যবহারটা আমাদের অনার্য ঐতিহ্য । তাহলে, শাঁখা সিঁদুর বিক্রির ব্যাপারটা
কী ? শাঁখা সিঁদুর তৈরির ব্যাপারটা কী ?—ব্যবসা না ঐতিহ্য ?
ব্যবসাকে যদি ঐতিহ্যের মধ্যে ধরি, তাহলে ডোম থেকে ধানচাষী পর্যন্ত ঐতিহ্যবান
বৃত্তিগুলো মরতে বসল কেন ? কারণ, প্রতিযোগিতায় পারছে না বলে । পুঁজির সঙ্গে পারবে
কেন ? তারচেয়েও বড় কথা, পুঁজির জোরের সঙ্গে পারবে কেন ? একই কথা পঞ্জিকা ব্রতকথা
এমনকী আমাদের শাড়ি ধুতি নিয়েও । আধুনিক জীবনযাত্রায় পঞ্জিকা ব্রতকথা আহ্নিক তর্পণ
যপতপের অবৈদিক প্রচলন খর্ব হয়েছে । এখানে মুসলমানেরা কিছুটা ধরে রেখেছে, কিন্তু
রাখতে গিয়ে তারা তো বঞ্চনার বলি হয়ে পিছিয়েও পড়েছে । অর্থাৎ আধুনিকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে
ঐতিহ্যবিরোধী, তাই না ? এদিক থেকে বামপন্থী পুঁজিবাদী সবএকই নৌকোয় । পাশাপাশি
দেখুন, আমাদের শারদোৎসবের অপব্যয়ক্লিষ্ট রমরমা ! সেখানে আবার আধুনিকতাকেই কলা
দেখানোর হুজুগ । অথচ শারদোৎসবের মতো টাটকা ব্যবসা, এতবড় লেনদেন, আর কোথায় পাবেন ?
এটাকেই বলব ঐতিহ্যপনা । যদি পুরনো পরম্পরা
বা ধারা বজায় রাখার নাম ঐতিহ্য দেওয়া যায়, যেমন গোত্র পদবী বংশ ইত্যাদি, তাহলে
বলতে হয় আদিবাসীরাই দেশের সবচে নির্ভেজাল ঐতিহ্যবান গোষ্ঠী । আবার যদি ভাষাসংস্কৃতির কথা বলা যায়,
তাহলে তার ঐতিহ্য খুঁজতে হবে দূরতম কোনো আলোকবর্ষে । কিন্তু প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক
ঐতিহ্য বলে কিছু হয় কি ? এলাকা বিশেষের পেয়ারা, আম, বৃষ্টি বা বরফ পড়ার কোনো
ঐতিহ্য হয় কিনা আমি জানি না । মুশকিল হল, ঐতিহ্য ব্যাপারটা তথাকথিত ইতিহাসও নয়,
উত্তরাধিকারও নয়, আবার মগজ ধোলাইও নয় । সাধারণভাবে,
ঐতিহ্য জিনিসটা অতীত বা মৃত, তার কোনো কোনো লক্ষণ আমরা আদর করে বজায় রাখতে পারি
সত্যি, কিন্তু ঐতিহ্যপনা জারি করতে পারি না । কারণ, ঐতিহ্য একটা পটভূমি, তাকে একালে ফিরে পাওয়া, বা
পালন করা, বা আপডেট করা অসম্ভব । ঐতিহ্যগত বৃত্তি, পেশা কিংবা গুণগত ব্যাপারগুলো
প্রথম বড়সড় ধাক্কা খায় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নতুন নতুন সুযোগসুবিধে চালু
হওয়ার পর । কোনো জিনিস আর কোথাও একচেটিয়া থাকতে
পারেনি, আর এই পৃথিবী এখন তো অনন্ত
কম্যুনিকেশনের ভাণ্ডার । এর কোনো সুপ্ত বা গুপ্ত অতীত আর বেঁচে থাকতেই পারে না । এদিকে ঐতিহ্য না থাকলে আবার
বামপন্থীদের বড় আহ্লাদ, ওঁরা মনে করেন ঐতিহ্যই নানারকম বিভাজনের মূলে । তার ওপর, ইদানীং শুনছি সংস্কৃত ভাষা আবার বেঁচে
উঠব উঠব করছে, ছাত্রছাত্রী বাড়ছে । একটা
ইংরেজি ভাষাই খেয়ে শেষ করতে পারলুম না, আধখাওয়া রইল, এর ওপর সংস্কৃতের চাপ পড়লে
ভাষা ব্যাপারটাই না তিকিতাকা হয়ে যায় ।
তখন হিন্দির কী হবে, তাই ভাবছি । তবেসংস্কৃত
চালু করতে হলেও এখনো ঢের সময় লাগবে, কারণ মাস্টারের খুব আকাল, এটা ঘটনা । তাছাড়া
সংস্কৃত শিখে কী ভবিষ্যৎ হবে আমরা জানি না । জাতির জীবনে আর একটা বিরাট অপব্যয়
চেপে বসলে, শুধু ঐতিহ্যের নামে, আমাদের সহ্য হবে তো ? আসলে জোর করে ঐতিহ্যপনা করতে
গেলে সেটা যেমন অপব্যয়ের শ্মশান হবে, তেমনি নতুন নতুন অবতারেরও জন্ম হবে, আর
প্রত্যেক অবতার এককোটি করে হিপোক্রিট বানাবে । তবু উন্নয়নশীল দেশ বলে, এদেশে
ঐতিহ্যের নাম করে নরবলি থেকে শুরু করে অনেক পাপই চলছে । দেশে সদ্য সদ্য লেখাপড়া
জানা অশিক্ষিতরা হাঁ করে তাই দেখছে, আর বাজার ভরে যাচ্ছে নকল মালে । পৃথিবীর আর কোনো উন্নত দেশে এসব হয় না । সুতরাং ঐতিহ্য হইতে সাবধান !
স্বর্ণেন্দু : আধুনিকতার সঙ্গীন চেহারাটা আপনি উল্লেখ করলেন আবার বামপন্থীদেরও ঐতিহ্যবিরোধী বলে কটাক্ষ করলেন । বামপন্থা সহজে মরে না বলে আমরা শুনেছি, তবে অজেয় নয় । এই নিয়ে কিছু বলুন —
সরসিজ : এই পৃথিবী থেকে বামপন্থীদের রাজনৈতিকভাবে তাড়াতে অনেক খরচা করতে হয়েছে
পুঁজিবাদীদের । তারজন্যে যেমন কোনো কোনো দেশের ভূগোল ভাঙতে হয়েছে, তেমনি কোথাও
আবার সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করতে হয়েছে ।
কোথাও আবার নাক গলাতে হয়েছে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে, বাজার-ব্যবসায় থাবা বসাতে হয়েছে বিভাজন সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র হয়েছে । এর মানে এই নয় যে, বামপন্থা বলতে ঠিক
এর উল্টোটাই বোঝায় । আসলে পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসটাই এমন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে,
সব মতাদর্শ এমন বুমেরাং হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত, যে বামপন্থা যেমন মরেও মরে না,
পুঁজিবাদ তেমনই হেরেও হারে না । তথাকথিত দুই পরাজিত মতাদর্শ তখন গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের রক্তমাংস
ছিঁড়ে খাওয়ার নতুন ছক কষে—এটাই আধুনিকতার রাজনৈতিক সারাংশ । পূর্ব ইয়োরোপের ছবিটা
একটু আলাদা ছিল । সেখানে বামপন্থীরা তুলনামূলকভাবে কম
ঝগড়ুটে, বেশি সন্দেহপ্রবণ এবং অত্যাচারী । কুন্দেরার লেখায় সব পাবেন । পশ্চিম
ইয়োরোপ আবার এত গণতন্ত্র কপচায় না, অথচ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা
উপভোগ করে পরিকাঠামোগত ভাবে, এটা ঘটনা । বামপন্থাকে তারা রাজনৈতিকভাবে ত্যাগ করতে
বাধ্য হয়েছে কারণ পুঁজিবাদকে ঠেকাতে গিয়ে বামপন্থা এতই পিছিয়ে পড়ে যে ইয়োরোপ ক্রমশ
দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল —অগ্রগামী আর পশ্চাৎগামী । কারণ
স্তালিনবাদের দাপটে মার্কসবাদের মানবিক মুখটা কোনোদিনই সামনে আসেনি ...
স্বর্ণেন্দু : আধুনিক ভারত, আপনি যাকে
ইণ্ডিয়া বলেছেন, একটা গণতান্ত্রিক দেশ । পৃথিবীর
বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত । অথচ আপনি বলছেন, পশ্চিম ইয়োরোপ সবচে বেশি
গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা উপভোগ করে ! আপনার এই পর্যবেক্ষণটা শুনতে চাই ।
সরসিজ : আপনি তো হামেশাই গণতন্ত্রের লজ্জা, গণতন্ত্রের উপর আঘাত, গণতন্ত্রের
কলঙ্ক, গণতন্ত্রকে হত্যা, গণতন্ত্রের কালো দিন এটসেট্রা দেখছেন, এগুলো কি তাহলে
পায়রার বোল, না নাটক ? আবার পাঁচ বছর অন্তর ভোটরঙ্গের মতো একটা উৎসব করে আপনাকে
বাধ্য করা হয় আপনারই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে কলা দেখাতে ! চিত্তির হয়ে যায় আপনার
রাজনৈতিক মতামত —তাই না ? সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক মতামতের গ্রহণযোগ্যতাই এখন
প্রশ্নের মুখে । হ্যাঁ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ছবিও আছে, কিন্তু তার ভিতটাকে আলগা
করে দেওয়ার উলঙ্গ রাজনৈতিক খেলাটাকে আপনি থামাবেন কীভাবে ? আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ
আপনি ২৪ X ৩৬৫দিন চালিয়ে যাবেন ? আপনার আর কোনো কাজকর্ম নেই
? তাহলে তো রাজনীতিকেই পেশা হিসেবে নিতে হয় ! যে দেশের মানসম্মান, ভবিষ্যতের
বারোটা বেজে গেছে, শিক্ষা ও অশিক্ষা গুলিয়ে গেছে, প্রশাসনে, বিচার ব্যবস্থায় লোকে
আস্থা হারিয়ে ফেলছে, ফড়েমি, জুলুম, চাঁদা, চুরি, তোলাবাজি, দালালি, কালোবাজারি
এইসব হচ্ছে নতুন নতুন বৈধ পেশার ছিরি, মারামারি-খুনোখুনি হচ্ছে রাজনৈতিক
বিনোদন—সেখানে যদি কেউ বলে, আমাদের গণতন্ত্র একটা বৃহৎ কার্টুনে পরিণত হয়েছে,
তাহলে আপনার বলার কিছু আছে ? এদিক থেকে পশ্চিম ইয়োরোপ কিন্তু অনেক সজাগ, সর্বস্তরে
দুর্নীতির সুযোগ নেই ওদেশে, তারা আমাদের মতো এতটা নির্লজ্জ নয়, নিজেদের হাস্যকর
করে তোলে না । কতগুলো সাধারণ
মানবাধিকারের নীতিকে তারা বাগিয়ে ধরে আছে । ব্যতিক্রম যে ঘটে না তা বলব না, আমি
নিজেই দেখেছি, কিন্তু প্রশাসনের নজরদারি খুবই আন্তরিক । বকলম পত্রিকায় এই জাতীয়
দু-একটি প্রবন্ধ আমরা ছেপেছি । পশ্চিমের ধ্বজা ওড়ানোর চেয়ে তাদের থেকে প্রয়োজনীয়
শিক্ষাটা নেওয়াই ভালো । কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনেতারা তাদের পয়সাটাই শুধু দেখেন,
পুঁজিপতিদের ডেকে এনে লগ্নী করাতে চান, অথচ শৃঙ্খলার শিক্ষাটা, সদিচ্ছার শিক্ষাটা
নিতেই চান না । গণতন্ত্রও তো আধুনিক জিনিস—তার কত যে ছিদ্র ! কাউকে কাউকে বলতে
শুনি আমাদের দেশের নাকি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আছে ! বুঝুন । আমাদের আঠারো উনিশ শতকের
গুরুকুল ঢের আগেই আমাদের এই ভবিতব্যটা বুঝেছিলেন । আমাদের সেটা বুঝিয়েছিলেন । কিন্তু
আমরা টোল, টিকি, টিকে, গরু, গণেশ, হনুমানের থেকে কক্ষনো একপা এগোতে চাইনি, মানে
ভবিষ্যৎটা তখনো বুঝতে চাইনি, এখনো বুঝছি না । সেদিনও আমরা যে অজুহাত দিয়েছি আজও
সেই অজুহাতবন্দী জীব হয়ে আছি । একজন
মনীষীর নাম করুন যাঁর কথা আমরা শুনেছি, যাঁকে অনুসরণ করেছি, পাবেন না । কিন্তু
মালা দিই সবার গলায় । এদেশের মানুষ নাকি বাইরের দিকে যতই দরিদ্র হোক তার অন্তর
সুমহান ঐতিহ্য আর উদারতার প্রতীক ! হ্যাঁ, এটাই হল আমাদের হিসটিরিয়ার প্রথম ধাপ –
তাও তো আমি এখানে মহিলাদের অবস্থানের কথাটা তুললুমই না ! ভাবুন, গণতন্ত্র মাইনাস
মহিলা, এই হল পরিস্থিতি । এই বাবাজাতিদের গণতন্ত্রে মা মহিলা সবাই ধরাশায়ী হয়েছে,
দাঁড়িয়ে আছে শুধু চারপেয়ে গরুমা । একটা কথা খুব পরিষ্কার, গণতান্ত্রিকতার দুর্গন্ধ
যখন ঢাকঢোল পিটিয়েও চাপা দেওয়া যায় না, তখন হাস্যকর নানারকমের সংরক্ষণ চালু করতে
হয় । তার মধ্যে দারিদ্র্য সংরক্ষণ, আক্রান্ত সংরক্ষণ, মাফিয়া সংরক্ষণও ধরবেন, নইলে
দেশের রাজনীতি বাঁচবে কি নিয়ে ! সুতরাং
বলতে হয়, গণতন্ত্র হইতেও সাবধান !
স্বর্ণেন্দু : অনেকগুলো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হোল, আবার বাংলা সাহিত্যের দিকে নজর দেওয়া যাক । আজকের সাহিত্যে কি গণতন্ত্রের এই বিপদের কোনো উল্লেখযোগ্য রিফ্লেকশন আপনি দেখছেন ?
সরসিজ : আচ্ছা, ভালো প্রশ্ন । একটা ব্যাপার লক্ষ করুন, এদেশের বেশিরভাগ মানুষ
সবসময় রাজনীতির তামাশার বাইরে থাকতে পছন্দ করেছে । তারপর, রাজনীতি একধরনের
দুর্নীতিমূলক পেশা হয়ে ওঠার সুবাদে, নানা জাতের রাজনৈতিক হারেম তৈরি হয়েছে, এটাকে
আমি রাজনৈতিক ভীমরতিও বলতে পারি ! তাদের কাজ তারা করছে – ফাটছে, ফাটাচ্ছে, ফট্ফট্
করছে ইত্যাদি । বাংলা সাহিত্য এই রাজনৈতিক ভীমরতির কথা সচরাচর বলতে চায় না,অথচ
সাহিত্যিকের শিয়রেও মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে,
তবু তার হাতে সহজিয়া রগড়, কারণ সে তো প্রতিষ্ঠানের খেয়েপরে ভালোই আছে ! ঐ
মৃত্যুটাও তার নয়, তার সাহিত্যের – সেটা সে জানে । খ্যাতির লোভে সে এখন সেয়ানা । এদিকে বাংলা বাজারে স্বাভাবিক মন্দা
এসেছে । অধিক সেয়ানায় সাহিত্য নষ্ট, সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতাই মারাত্মক ধাক্কা
খেয়েছে । পুরস্কার আর প্রচার তার বাঁচার শেষ ভরসা ! সুতরাং রিফ্লেকশন খুঁজতে হলে
যারা মায়াবাজারের ভণ্ড খ্যাতির মজায় মজেনি, প্রতিষ্ঠানের ধার ঘেঁষেনি, অসৎ
প্রশংসায় বিপথগামী হয়নি, তাদের রচনার মধ্যেই খুঁজতে হবে । সেরকম কাজ আর কতটুকু
হয়েছে ঐ বিপুল আবর্জনার তুলনায় ? এই নিয়ে আমি খুব ছোট্ট একটা নিবন্ধ লিখেছিলুম, বকলমেই
বেরিয়েছিল ২য় বছরের ২য় সংখ্যায়, তাতে আমার এই দৃষ্টিভঙ্গিটা স্পষ্ট পাওয়া যাবে ।
স্বর্ণেন্দু : আচ্ছা লেখাটা আমি পড়ব
। কিন্তু আপনি তো খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন ...
সরসিজ : রা...মো...চ...ন্দ্র ! আমি প্রশ্ন তুলব কেন ! বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকেই
এই সন্দেহটা প্রশ্ন আকারে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে । দেখুন, হিন্দু বাঙালির যেহেতু একটা
হ্যাংলামোয়-পাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজ আছে, আর বাংলাসাহিত্য যেহেতু সেই সুবিধেবাদী
মধ্যবিত্তেরইখেয়ালে সৃষ্টি, সুতরাং তার সাহিত্যে মধ্যবিত্ত আর মধ্যমেধার যুগলবন্দী
তো ঘটবেই ঘটবে, সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতা কমবে । এ তো একটা মোটা দাগের ব্যাপার,
আপনারা টের পান না ?
স্বর্ণেন্দু : অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সমাজকে তিরস্কারের একটা জায়গা থাকছেই ?
সরসিজ : তিরস্কারের কথা নয় ভাই, মধ্যবিত্ত সারা পৃথিবীতেই আছে, কিন্তু তাদের গড়ে
ওঠার ইতিহাসের ওপরেই অনেকটা নির্ভর করে তাদের চরিত্রদোষ । এ নিয়ে গাদা গাদা লেখা হয়েছে । যাই
হোক, মধ্যবিত্তের কাজটা কী বলুন ? সমাজের যাবতীয় দোষগুণ, ন্যায়অন্যায়, ধর্মাধর্ম,
সত্যমিথ্যা ধারণ ও প্রতিপালন করা । এর সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ঠাঁটগুলোও আছে : সবার চোখে ভালো হওয়া, মানুষ হওয়ার ইচ্ছে/ভয়, ইত্যাদি । এইবার হয়েছে কী,
রাজনীতির পদ্ধতি বদলে যাওয়াতে ইদানীং মধ্যবিত্তের একটা সুযোগসন্ধানী অংশের আর্থিক
স্বাচ্ছন্দ্য আর শক্তি খানিক বেড়েছে । সেই বাড়তি শক্তিটাকে কাজে লাগাবার জন্য এবার
প্রাণপণ ফন্দি আঁটছে রাজনৈতিক শক্তিগুলো তথা ব্যবসাবাজরা । কিন্তু শক্তি বাড়লেও,
মধ্যবিত্তের পক্ষে সরাসরি শক্তির খেলায় নামাটা একটু বিপজ্জনক । বিশ্বায়নের জগতে
মধ্যবিত্তের বিশ্বাসযোগ্যতার নতুন কোনো মাপকাঠি নেই, সুতরাং সে তার দেখনদারির দিকে
নজর দিয়েছে বেশি, স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দিয়েছে বেশি । সুবিধেবাদীরা তো
সুবিধেবাদই বেছে নেবে! আবার যেখানে যেখানে এই উঠতি মধ্যবিত্তরা রাজনৈতিক
প্রতিনিধিত্বের দিকে ঝুঁকছে সেখানে একেবারে হাতেনাতে দূষিত হচ্ছে পরিস্থিতি ।
রাজনৈতিক দূষণের সঙ্গে সুবিধেবাদী মধ্যবিত্তের ভণ্ডামি মিলে গিয়ে তৈরি হচ্ছে ছোটবড়
রাজনৈতিক হারেমের জট । হারেম বলতে আমি দলদূষিত
সংগঠন বোঝাচ্ছি ।
স্বর্ণেন্দু : খানিক আগে আপনি
বলেছেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের মননশীল বেইমানী’ । কথাটার
মধ্য দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন ?
সরসিজ : ওটা একটা মন্তব্য । যেমন তিনটি বুদ্ধিজীবী এক জায়গায় থাকলে চারটি দল
হয়—এটা আর একটা মন্তব্য । সাধারণ মানুষ সেজে থাকা এসব সেকেণ্ড হ্যান্ড
বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত লোভ, দলবাজি বা ভণ্ডামির কথা তো আপনাদের নিজেদের
অভিজ্ঞতাতেও জ্বলজ্বল করছে । বুদ্ধিজীবী আর ছদ্মবুদ্ধিজীবীর মধ্যে এখন পার্থক্য অনেকটা
পরিষ্কার হয়ে গেছে । এটাই আবার গুলিয়ে দেবার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তৎপর । লোক ঠকানোর কাজে শুধু রাজনীতিকরাই
এককাট্টা নয়, বুদ্ধিজীবী দোসর হয়েছে । তাই
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ছবিটা এখন আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নেই, সিপিয়া কালার হয়ে
গেছে ।
স্বর্ণেন্দু : প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন ? বকলম-কে তার সাথে
কীভাবেই বা রিলেট করবেন ?
সরসিজ : দেখুন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা বলতে আমরা বুঝি আপোস না করার একটা
মায়াবাজার-বিমুখ রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক
অবস্থান, কিংবা ‘অপরাধ’, যা বলতে চান— এবং সেটা ইস্যুভিত্তিক
নয়, নীতিগত । এই নীতি কথাটার অণু-পরমাণু আমি আর এখানে ভাঙছি না, অনেক তর্ক এসে
যাবে । কিন্তু এখানে প্রতিষ্ঠান কে ? প্রতিষ্ঠান বলতে কি ধ্রুব বা অচলায়তন ক্ষমতার
আকাশ ? না কি পরিবর্তনের জামা গায়ে কোনো ‘উলঙ্গ রাজা’ ? জিজ্ঞাসাচিহ্ন, কারণ এই
প্রশ্নে দাঁড়ি টানা সোজা কথা নয় । আবার প্রতিষ্ঠানের নামাবলী ছাড়া কোনো সামাজিক
প্রথাই দীর্ঘজীবী হয় না : প্রথাকে বাঁচতে হলে তার প্রতিষ্ঠান
চাই । তবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চরিত্রগত ভাবে
এক নয় । এককথায় বললে, প্রতিষ্ঠান হল ক্ষমতা নিজেই—সে কখনো পৃষ্ঠপোষক, কখনো
পৃষ্ঠপ্রদর্শক । আর প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হল প্রতিষ্ঠানের নাকের পোঁটা । তবে আজকের
সোস্যাল মিডিয়ার জগতে, অনন্ত কম্যুনিকেশনের যুগে, আপোসহীন প্রতিষ্ঠান-বিরোধী
ব্যক্তির স্বাভাবিক একাকীত্ব হয়ত কিছুটা কমেছে, যদিও তাতে তার অবস্থানগত বিপদ
কমেনি, বড়জোর সে তার যন্ত্রণার সমব্যথীদের খুঁজে পেয়ে থাকবে । আর এখানেই আসবে
স্বাধীনতার প্রশ্ন, নতুন চিন্তা নির্মাণের অধিকার । তবে শেষ পর্যন্ত জটিলতাটা
পদ্ধতিগত: প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন। আবার
সেই পদ্ধতির মধ্যেও প্রতিষ্ঠান ফোড়ন দিতে
আসে, এত নির্লজ্জ ! আর তার ফল কী হয় জানেন ? গোটা একটা আন্দোলন পর্যন্ত
প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পড়ে যায়, ব্যক্তিমানুষ তো ছার ! এবার দেখুন, সাধারণ দৃষ্টিতে
যেটা ‘আপোসহীনতা’ দেখায় তার তো একটা কাজের দিক বা অ্যাকটিভ দিকও থাকবে, আপোসহীনতা
কথাটার মধ্যে কিন্তু সেই অ্যাকটিভ দিকটা পুরো খুঁজে পাওয়া যায় না, উল্টে
প্রতিষ্ঠান-বিরোধীর আচরণগত বা সিদ্ধান্তগত গোঁয়ার্তুমিটাই বড় হয়ে ওঠে, সেটা ঠিক
নয়, সেইজন্যে ওই ন্যাংটো আপোসহীনতা কথাটায় আমার সায় দিতে ইচ্ছে করে না । আবার
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার অ্যাকটিভ বা কার্যকরী দিকটায় নজর দিলে দেখা যাবে প্রথাসিদ্ধ
দীর্ঘজীবী চলনগুলোর বাইরে কিছু করতে গেলেই আপনি বাধা পাবেন, ব্যর্থ হবেন । এদিকে
প্রথাসিদ্ধতা ছাড়া, সহজিয়া পন্থায় পা মেলানো ছাড়া, বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবার
উপায়ও নেই । স্বাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষাই বলুন আর মননশীলতাই বলুন, চেটে খাবার মতো
সহজপাচ্য জিনিস তো নয় । সেইজন্যে আগে বোঝা দরকার প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা যদি আপনার
নীতিগত লড়াইয়ের যন্ত্রণা হয়, সেটা কী পদ্ধতিতে জনরুচির বিরুদ্ধে যাচ্ছে,
প্রথাসিদ্ধতার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, এবং শেষ পর্যন্ত কী উপায়ে আপোসকামিতার বিরুদ্ধে
যাচ্ছে । এবং সেটা সবসময় সাংগঠনিক চরিত্র নাও পেতে পারে, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তও হতে
পারে । এখানে আরও একটা কথা বলে রাখি, আমি এই যে সামাজিক অবস্থানগুলোর বিরুদ্ধে
যাবার কথা বললুম, কেউ কেউ এই পরিস্থিতিটার রাজনীতিকরণ করতে গিয়ে উগ্রপন্থী
ক্রিয়াকলাপকেও এই জায়গায় কোট করেন, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা আর রাজনৈতিক
নৈরাজ্যবাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক অনিবার্য করে তোলেন, যেটাকে আমি আগেই
প্রতিষ্ঠান-বিরোধীর অবস্থানগত বিপদ বলেছি । পাশাপাশি আমি প্রতিষ্ঠান-বিরোধীর
একাকীত্ব কমে গিয়ে সমব্যথী খুঁজে পাবার কথাও তুলেছি, যেটা তার লড়াইয়ের যন্ত্রণাকে
আবার যূথস্নেহে টেনে আনছে সরাসরি মননের বা মত বিনিময়ের জগতে, ইন্টারনেট বা
পত্রপত্রিকার মধ্যে দিয়ে । বোঝাতে পারলুম কি ?—আর হ্যাঁ, বকলম লিট্ল ম্যাগাজিন
হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশীদার, এবং আমরা সহজপাচ্যতার
দিকে বেশি না ঝুঁকে আপাতত মর্মগ্রহণের চেষ্টাই চালাচ্ছি বেশি । দেখা যাক, আরও
কিছুটা কাজ করি, আমাদের সাধ ও সাধ্যের ভেতর থেকে আর কোনো রুপোলি রেখা খুঁজে পাই
কিনা ।
স্বর্ণেন্দু : অনেক কথা খোলাখুলি উঠে এল । এবার আবার আসি বকলম পত্রিকার কথায় । এটাই আমার শেষ প্রশ্ন । বকলম-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন হতো, কিন্তু আমার আগ্রহ আরও স্পেসিফিক, যে, বকলম কি বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় মন দেবে, নাকি আরও কিছুদিন রাজনৈতিক-সামাজিক জটগুলো খোলার কাজে পশ্চিমের তাত্ত্বিক শিক্ষাগুলো নিয়ে কাজ করে যাবে ?
সরসিজ : আমাদের সদিচ্ছা আছে জট খোলার কাজে লেগে থাকার, কিন্তু পরিশ্রমী লেখকের বড্ড
অভাব । অনুবাদকের অভাবও খুব চিন্তায় ফেলেছে । হয়ত সেজন্যই যে কাজটা একটু পরে শুরু
করতুম, সেটাই একটু আগে করতে হতে পারে । তবে সেটাকে আমি আপাতত ভারতীয় সংস্কৃতির
পুনর্নির্মাণ বা পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা গোছের অ্যাকাডেমিক নাম দেব না । সম্ভবত সেটা
শুরু হবে প্রাচীন লোকসংস্কৃতিরমূল দাপটের জায়গাটা নিয়ে, যেখান থেকেবৈদিক পুরাণ
সাহিত্য ইত্যাদি নিজের মাটিটা ছিনিয়ে নিয়েছে; অধ্যাত্মবাদ থেকে জন্ম নিয়েছে
বিচ্ছিন্নতা, আধিপত্যবাদী রাজনীতি, থাকবন্দী সমাজ, ইত্যাদি । অবশ্য এখনকার রাজনীতি
যেখানে জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কীর্তনসংস্কৃতি দিয়ে মুখ আড়াল করার চেষ্টা
করছেসেই সূত্রগুলোর উপরেও আমাদের আরো কাজ করার আছে । আপাতত লেখক চাই, লেখক ।
স্বর্ণেন্দু : আশা করি আপনাদের পাঠকদের মধ্যে থেকেই লেখককে খুঁজে পাবেন । এই সাক্ষাৎকারটা আশা করব আমাদের পাঠকদেরও বকলম পত্রিকা সম্বন্ধে উৎসাহিত করবে । সরসিজদা, অনেকটা সময় আপনাকে ব্যস্ত রেখেছি, অনেক ধন্যবাদ, নমস্কার নেবেন ।
সরসিজ :আমারও শুভেচ্ছা রইল , ভালো করে কাজ করুন ।
...........................................................................................................................................
.................................................................................................................................................
১। সঙ্গদেবতা (গল্প), ১৯৯৯
২। নিহিত পাঠসেবা (কবিতা), ২০০০
৩। রুশের রহসে (উপন্যাস), ২০০১ (পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১৯)
৪। গুহাবাসীদের শোভাযাত্রা (কবিতা), ২০০৫
৫। পাতি অবতার (গল্প), ২০০৬
৬। উড়ঞ্চড়ের বেদান্ত (নকশা), ২০০৯
৭। স্পর্শকাতর পদাবলী (কবিতা), ২০০৭
৮। বিবিধ বাওয়াল (মিনিগল্প), ২০০৮ /(পরিমার্জিত ও পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ ২০১৮)
৯। নির্জনশ্রুতি (কবিতা), ২০০৯
১০। ফিউশান একতারা (কবিতা), ২০১৬
১১। বিশ্ববীক্ষা (সম্পাদনা), ২০২০ (বকলমে প্রকাশিত পাশ্চাত্য মনীষীদের সাড়া জাগানো প্রবন্ধমালার মধ্য থেক ৪৮ জনের প্রবন্ধের অনুবাদ সংকলন)
১২। রিজার্ভ কাহিনী (গল্প), ২০২০
১৩। বৈষ্ণবোচিত (গদ্য), ২০২০
সম্পাদনা:- বকলম পত্রিকা
প্রসঙ্গত, বকলম পত্রিকাটি ২০১১-র জানুয়ারিতে প্রথম প্রকাশের পর থেকে ২০২০-র জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৮ টি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে।
** প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যাগুলির থেকে কয়েকটির
বিষয়সূচির ফোটোকপি এখানে রাখা হলো, পাঠকের অনুসন্ধিৎসার আগাম অনুমানে ।
..............................................................................................................................................
১। ধানইন্দিরা : কাব্যগ্রন্থ : কবিয়াল : ২০১২ (পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৭)
২। পিতার জন্ম হয় : কাব্যগ্রন্থ : মনফকিরা : ২০১৫
৩। ফাঁসুড়েকে বিবাহপ্রস্তাব :মার্গারেট এটউড এর কবিতার অনুবাদ : ভাষালিপি : ২০১৮
৪। গুয়ান্তানামো : স্মৃতিকথা সাক্ষাৎকার কবিতা ছবি : সংকলন সম্পাদনা ভাষান্তর : বইপত্তর : ২০১৯
৫। নতুন এক নীরবতা : যোশেফ ম্যাসির কবিতার অনুবাদ : ভাষালিপি : ২০২০
A great exploring the works and views of brilliant poet and writer সরসিজ বসু. Thanks to poet স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত for publishing the interview.
ReplyDelete